মার্কিন ডলার সংকটের কারণে বিদ্যুৎ খাতের বিল পরিশোধ করতে পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। এই সংকটের কারণে বিল পরিশোধ না করায় যথাসময়ে জ্বালানি তেল, কয়লা আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন, হচ্ছে লোডশেডিং। এমনকি ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের বিলও বকেয়া রয়েছে। বিল বকেয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রায় জরিমানাও গুনতে হচ্ছে সরকারকে।
এ অবস্থায় চলতি অর্থবছরের বকেয়া ও আগামী অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দরকার, তার সম্ভাব্য ব্যয়ের আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে। দুই অর্থবছর মিলিয়ে এর পরিমাণ ৫ হাজার ৯২১ দশমিক ০৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৩ হাজার ৯৪৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা (১০৮ টাকা ধরে)। প্রাক্কলিত এই হিসাব শিগগির প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হবে বলে বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান।
জানা যায়, চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের বিপরীতে বকেয়া বিলের পরিমাণ ৪৭৫ দশমিক ০৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর আগামী অর্থবছরে (২০২৩-২৪) এ খাতে ১ হাজার ৭৫৫ দশমিক ২৪ মার্কিন ডলার প্রয়োজন হবে। আইপিপি (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার), রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য জ্বালানি তেল (ফার্নেস অয়েল) আমদানির বিপরীতে চলতি অর্থবছরের বকেয়া রয়েছে ৮৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। চলতি বছরের মোট বিলের ৫৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এরই মধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে। আর আগামী অর্থবছরে এই খাতে প্রয়োজন হবে ২৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে নির্মিত ও বড় আইপিপি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানির বিপরীতে চলতি অর্থবছরের বকেয়া রয়েছে ৫৭৩ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এরই মধ্যে বাংলাদেশ-চীনের যৌথ মালিকানায় নির্মিত পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার বিল বাবদ ১৮০ মিলিয়ন ডলার এবং বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে নির্মিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার বিল বাবদ ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এই খাতে আগামী অর্থবছরে ১ হাজার ৫১৩ দশমিক ০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন হবে।
এ ছাড়া ডিজেলভিত্তিক মোট এক হাজার মেগাওয়াটের আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চলতি অর্থবছরের বিল পরিশোধ করতে লাগবে ১৬১ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর আগামী অর্থবছরে এ খাতে প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৭ দশমিক ৬৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইসিএ (এক্সপোর্ট ক্রেডিট এজেন্সি) অর্থায়নে বাস্তবায়িত বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রকল্পগুলোর রিপেমেন্ট করার জন্য চলতি অর্থবছরের জন্য প্রয়োজন ৭৩ দশমিক ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আগামী অর্থবছরে এই খাতে প্রয়োজন হবে ১৪৬ দশমিক ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ছাড়া পিডিবির বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের লং টার্ম সার্ভিসেস এগ্রিমেন্ট (এলটিএসএ)-এর বিল পরিশোধ করতে চলতি অর্থবছরের জন্য প্রয়োজন ১৪ দশমিক ০৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রয়োজন হবে ২৮ দশমিক ০৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি ডলারের অভাবে কয়লার বিল পরিশোধ করতে না পারার কারণে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের বিল পরিশোধ করতে না পারার কারণে জ্বালানি তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চালানো যায়নি। কারণ সরকার বিল পরিশোধ না করার কারণে বেসরকারি উদ্যোক্তারা জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারেনি। এ কারণে গত মাসের শেষে এবং চলতি মাসের শুরুতে ভয়াবহ লোডশেডিং করতে হয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থা করা না হলে আগামীতেও ভয়াবহ লোডশেডিংয়ে পড়তে হবে।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সময়মতো ছাড় করেনি অর্থ মন্ত্রণালয়। এমনকি ভতুর্কির টাকা ছাড় করতেও গড়িমসি করেছিল। যে কারণে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে যাতে ফের পড়তে না হয় এবং প্রয়োজনীয় অর্থ যাতে দ্রুত ছাড় করা হয়, সেজন্য চলতি অর্থবছরের বকেয়া এবং আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাক্কলন হিসাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে উত্থাপন করা হবে। সরকারের কাছে আগামী জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ছয় মাস অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ ঠিক রাখতে না পারলে জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে। যে কারণে সরকারও এ সময়টাকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে।
এ বিষয়ে কথা বলতে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
মন্তব্য করুন