পারিবারিকভাবে আত্মীয়তার সুবাদে মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন ওরফে রুফির সঙ্গে পরিচয় ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী হুমায়রা হিমুর। সেই পরিচয় থেকে সম্পর্ক রূপ নেয় ঘনিষ্ঠতায়। একসময় হুমায়রা হিমুকে বিয়ের আশ্বাসও দেন রুফি। কিন্তু অনলাইন জুয়ায় আসক্ত ছিলেন হিমু। এই নিয়ে তাদের মধ্যে প্রায়ই চলত বাগবিতণ্ডা। এ ছাড়া রুফির সঙ্গে আরও কিছু বিষয় নিয়ে ঝামেলার কারণে একসময় হতাশা থেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন এ অভিনেত্রী। রাজধানীর উত্তরায় নিজ বাসায় হিমুর আত্মহত্যার ঘটনায় তার প্রেমিক মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন ওরফে রুফিকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য জানায় র্যাব।
গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, হিমু এর আগেও তিন-চারবার রুফিকে জানিয়েছিলেন তিনি আত্মহত্যা করবেন। তবে করেননি। বৃহস্পতিবার তাদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হয়। হিমু তখনো বলেছিলেন তিনি আত্মহত্যা করবেন। রুফি এবার পাত্তা দেননি। পাত্তা না দেওয়ায় আরও ক্ষিপ্ত হয়ে আত্মহত্যা করেন হিমু।
তিনি বলেন, এ ঘটনায় হিমুর খালা রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার দায়ে একটি মামলা করেন। মামলায় রুফিকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
আসামিকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে মঈন জানান, ২০১৪ সালে হিমুর খালাতো বোনের সঙ্গে রুফির বিয়ে হয়েছিল এবং কিছুদিনের মধ্যে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। হিমুর খালাতো বোনের সঙ্গে জিয়াউদ্দিনের বিবাহ বিচ্ছেদের পরও হিমুর সঙ্গে রুফির যোগাযোগ ছিল। পরবর্তী সময়ে রুফি আবার অন্য জায়গায় বিয়ে করলেও হিমুর সঙ্গে সে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ রাখত। গত ৪ মাস আগে তাদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয় এবং রুফি হিমুকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়মিত তার বাসায় যাতায়াত শুরু করে। কিন্তু বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া ও বাগবিতণ্ডা হতো। এ ছাড়া দুই-তিন বছর ধরে হিমু বিগো লাইভ অ্যাপে অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় করেছে বলে রুফি জানান। এসব বিষয় নিয়েও বিভিন্ন সময় তাদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা ও মনোমালিন্যের সৃষ্টি হতো।
রুফিকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র্যাব জানায়, বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টায় জিয়া হিমুর উত্তরার বাসায় যায়। পরবর্তী সময়ে অনলাইন জুয়াসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভিকটিম হিমু ও জিয়াউদ্দিনের মধ্যে বাগবিতণ্ডার একপর্যায় হিমু ভাঙচুর করে। একপর্যায়ে হিমু রুমের বাইরে থেকে একটি মই এনে রুমে ঢুকে। সিলিং ফ্যানের হ্যাংগারে আগে থেকেই বেঁধে রাখা প্লাস্টিকের রশিতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করবে বলে তাকে জানায়।
রুফি র্যাবকে জানায়, হিমু আগেও তিন-চারবার আত্মহত্যা করবে বলে জানালেও পরবর্তী সময়ে আত্মহত্যা করেনি। এবারও আগের মতো আত্মহত্যা করার ব্যাপারে জানালে তিনি বিষয়টি গুরুত্ব দেননি। এর মধ্যেই ‘আমি কি মরতে পারি না, দেখ পারি কি না’ বলে হিমু দড়িতে ঝুলে পড়ে। রুফি তখন হিমুর বিছানায় বসে ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে দেখতে পায় হিমু সত্যি সত্যি গলায় ফাঁস দিয়েছে। তখন সে হিমুকে নামানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এ সময় সে পাশের রুমে থাকা হিমুর মেকআপ আর্টিস্ট মিহিরকে ডেকে আনেন। পরবর্তী সময়ে মিহির রান্নাঘর থেকে একটি বঁটি এনে রশি কেটে তাকে নিচে নামায়। রুফি ও হিমুর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মেসেজ চালাচালি পাওয়া গেছে। পরবর্তী সময়ে রুফি, বাসার দারোয়ান এবং মিহিরের সহায়তায় হিমুকে বাসা থেকে রাজধানীর উত্তরার একটি হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক হিমুকে মৃত ঘোষণা করেন।
র্যাব জানায়, দুই-তিন বছরে হিমু অনলাইন জুয়ায় ৪০ থেকে ৪৫ লাখ টাকা খোয়ান। এ টাকার মধ্যে ২১ লাখ টাকা রুফি দিয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাবকে।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রুফি ‘ও’ লেভেল শেষ করে টেক্সটাইল কেমিক্যালের ব্যবসা করত। পাশাপাশি সে তার খালাতো বোনের সাবেক স্বামী ছিল। ঘটনার দিন হিমুকে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করার পরে সে হিমুর ব্যবহৃত দুটি আইফোন ও গাড়ি নিয়ে দ্রুত হাসপাতাল ত্যাগ করে। পরবর্তী সময়ে সে হিমুর গাড়ি উত্তরার বাসার পার্কিংয়ে রেখে দেয়। এরপর মোবাইল ফোন দুটি বিক্রির উদ্দেশ্য নিয়ে রাজধানীর বংশাল এলাকায় পালিয়ে যায়। সেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় আরও কোনো ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মায়ের কবরের পাশে সমাহিত: লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানান, হুমায়রা হিমুকে তার মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়েছে। শুক্রবার রাত সোয়া ৮টার দিকে লক্ষ্মীপুর শহরের লামচরী জামে মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হয়। এর আগে রাত ৮টায় মসজিদ প্রাঙ্গণে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।