শেখ হারুন
প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২৩, ০২:৫৮ এএম
আপডেট : ১১ আগস্ট ২০২৫, ০১:১৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভেস্তে গেল মশা মারতে মহালুটের আয়োজন

প্রকল্পে ব্যয় কমলো ১০৭ কোটি টাকা
ভেস্তে গেল মশা মারতে মহালুটের আয়োজন

১০০ লাখে যে ১ কোটি হয়, সেটি হয়তো ভুলেই গিয়েছিল স্থানীয় সরকার বিভাগ। এ কারণেই হয়তো তারা হাত ধোয়া এবং পানি খাওয়ার জন্য একেকটি ওয়াটার পয়েন্ট নির্মাণে ১ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করেছিল। অথচ এ ওয়াটার পয়েন্ট মাত্র ১ লাখ ১৬ হাজার টাকায় নির্মাণ করা সম্ভব। তার মানে এ ধরনের প্রতিটি পয়েন্টের জন্য ৯৮ লাখ ৮৪ টাকা বেশি চাওয়া হয়েছিল।

শুধু ওয়াটার পয়েন্ট নির্মাণ নয়, ‘ইম্প্রুভমেন্ট অব আরবান পাবলিক হেলথ প্রিভেন্টিভ সার্ভিস’ শীর্ষক প্রকল্পে আরও অনেক খাতে এমন অস্বাভাবিক বরাদ্দ প্রস্তাব করেছিল স্থানীয় সরকার বিভাগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে মহালুটপাটের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে যাচাই-বাছাই শেষে পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তিতে সেই আয়োজন ভেস্তে গেছে।

জানা গেছে, প্রকল্পটির আওতায় হাত ধোয়া এবং পানি খাওয়ার জন্য শহরের বিভিন্ন জনবহুল স্থানে ২০টি ওয়াটার পয়েন্ট নির্মাণে ২০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছিল স্থানীয় সরকার বিভাগ। অর্থাৎ একেকটি ওয়াটার পয়েন্টের জন্য খরচ ধরা হয়েছিল ১ কোটি টাকা। তবে পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তির পর এখন ৮৬টি ওয়াটার পয়েন্টের জন্য ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র ১ কোটি টাকা। তার মানে প্রকল্প প্রস্তাবে যেই খাতে একটি পয়েন্ট নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, সেই টাকায় নির্মাণ হবে ৮৬টি! এর মধ্য দিয়ে সরকারের ১৯ কোটি টাকাই সাশ্রয়ের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য নির্মাণ হচ্ছে বাড়তি ৬৬টি ওয়াটার পয়েন্ট।

জানা গেছে, শুধু ওয়াটার পয়েন্ট নয়, প্রকল্পটির আওতায় টয়লেট নির্মাণ খাতেও অত্যধিক ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রস্তাবনায় ২০টি মোবাইল পাবলিক টয়লেট নির্মাণে চাওয়া হয়েছিল ৫৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি পাবলিক টয়লেট নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছিল ২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এখন ৫০টি মোবাইল টয়লেট ও ৫০টি পাবলিক টয়লেট নির্মাণে মোট ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। প্রতিটি পাবলিক টয়লেট নির্মাণে ৫২ লাখ টাকা এবং মোবাইল টয়লেটে ২৭ লাখ টাকা ব্যয় হবে।

পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বৈদেশিক ঋণের টাকায় রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে মশাবাহিত বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে ১ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছিল স্থানীয় সরকার বিভাগ। সেখানে বেশ কিছু খাতে অস্বাভাবিক ব্যয় ধরা হয়েছিল। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলে পরিকল্পনা কমিশন। পিইসি সভায় জবাবদিহির অস্বাভাবিক ব্যয়ের প্রস্তাব কমাতে বাধ্য হয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। কয়েক দফা যাচাই-বাছাই শেষে গত একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়—যাতে ব্যয় কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ১৮১ কোটি টাকা, যা মূল প্রস্তাবের চেয়ে ১০৭ কোটি টাকা কম। অনুমোদিত ব্যয়ের মধ্যে ১ হাজার ৭৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা ঋণ হিসেবে দেবে বিশ্বব্যাংক। বাকি ১০৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় হবে।

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) পরিচালক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, ‘অর্থ আত্মসাতের লক্ষ্যেই এ ধরনের অস্বাভাবিক ব্যয় প্রস্তাব করা হয়। যারা এমন ব্যয় প্রস্তাব করেছে তাদের জেলে নেওয়া উচিত। জেনেশুনে যারা এমন অস্বাভাবিক ব্যয় প্রস্তাব দেয় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এ অপকর্ম চলতেই থাকবে।’

তিনি বলেন, ‘সরকারের উচিত যে কোনো প্রকল্পে ব্যয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে যারা বিশেষজ্ঞ তাদের দিয়েই ব্যয় নির্ধারণ করা। তাহলে যথাযথভাবে ব্যয় নির্ধারণ করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের দিয়ে মূল্যায়ন করা হলে হয়তো ব্যয় আরও কমত। কারণ ব্যয় নির্ধারণের কাজ পরিকল্পনা কমিশনের নয়। তার পরও পরিকল্পনা কমিশন যাচাই-বাছাই করে ভালো করেছে।’

যোগাযোগ করা হলে স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিকল্পনা অনুবিভাগের মহাপরিচালক ডা. মো. সারোয়ার বারী কালবেলাকে বলেন, ‘ওই প্রকল্পের প্রস্তাব তৈরিতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ছিল বিশ্বব্যাংকের। তাদের পরামর্শেই প্রস্তাব তৈরি করা হয় এবং ব্যয় প্রস্তাবও তাদের ছিল। সম্ভবত তারা জায়গার মূল্যসহ নির্মাণ ব্যয় ধরেছিল। তারা হয়তো ভেবেছিল জমি কেনা লাগবে।’

তিনি বলেন, ‘পরিকল্পনা কমিশন যাচাই-বাছাই করে যেটি যৌক্তিক মনে করেছে সেটিই করেছে। তাদের কাছে যেহেতু মনে হয়েছে ব্যয় বেশি হয়েছে। তাই তারা কমিয়ে দিয়েছে। এটি ভালো হয়েছে। এখন যে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে সেই খরচেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।’

নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রকল্পটিতে মশা মারার ধোঁয়া ছাড়ার ১০০টি হ্যান্ড স্প্রেয়ার পাম্প কিনতে ৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। অথচ এখন ২ কোটি ৮০ লাখ টাকায় ৭০০টি স্প্রেয়ার পাম্প কেনা হবে। অর্থাৎ একেকটি স্প্রেয়ার পাম্প কিনতে খরচ হবে মাত্র ৪০ হাজার টাকা। অথচ প্রতিটির জন্য চাওয়া হয়েছিল ৫ লাখ টাকা। এই দামে ৭ গুণ বেশি যন্ত্র মিলছে। এখানে সাশ্রয় হয়েছে ২ কোটি ২০ লাখ টাকা।

একেকটি ফগার মেশিন কেনার জন্য ৫ লাখ টাকা করে চাওয়া হয়েছিল। অথচ সেই একই ফগার মেশিন কিনতে এখন খরচ হবে আড়াই লাখ টাকা করে। এখানেও সাশ্রয় হচ্ছে ২ কোটি ২০ লাখ টাকা। দুটি থার্মাল মেশিন কেনার জন্য চাওয়া হয়েছিল ৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিটির দাম ধরা হয়েছিল ২ কোটি টাকা। এখন প্রতিটি কেনা হবে মাত্র ১২ লাখ টাকায়। পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তিতে এখন ১৮টি মেশিন কেনা হবে মাত্র ২ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

প্রকল্পের প্রস্তাবনায় ৬০ কর্মকর্তাকে বিদেশে প্রশিক্ষণে পাঠাতে ১০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিল। তবে কর্মকর্তা সংখ্যা না কমলেও এ খাতে ব্যয় কমেছে ৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া আরও কয়েকটি খাতে অপ্রয়োজনীয় প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয় কমেছে। এ ছাড়া আরও বেশি কিছু খাতে অপ্রয়োজনীয় এবং অতিরিক্ত ব্যয় কমানো হয়েছে।

অবশ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা ক্ষেত্রে কাটছাঁট হলেও বেশ কিছু খাতে এখনো স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রকল্পের জন্য বিভিন্ন ধরনের ১০৫টি করে চেয়ার ও টেবিল এবং ১৫টি সোফাসেট কেনা হবে। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘চেয়ার-টেবিল কেনার জন্য এত টাকা বরাদ্দ অস্বাভাবিক। এটি প্রয়োজনীয়তা আছে নাকি সেটি আগে নিশ্চিত হতে হবে। এ বিষয়ে যারা জানেন তাদের কাছে পরামর্শ নিয়ে অনুমোদন দেওয়া উচিত ছিল।’

প্রকল্পটির প্রস্তাবনায় স্থানীয় সরকার বিভাগ বলছে, বর্তমানে শহরাঞ্চল, বিশেষ করে সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভার বাসিন্দারা ভেক্টর (মশা) এবং ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ইত্যাদির মতো ভেক্টরবাহিত রোগে আক্রান্ত। ডেঙ্গুর প্রকোপ শহরবাসীর জন্য একটি বড় উদ্বেগ-হুমকি। তাই মশাবাহিত বিভিন্ন রোগে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। মশা মারার পাশাপাশি মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং অসংক্রামক রোগ বিষয়েও কার্যক্রম থাকবে এ প্রকল্পে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, সাভার পৌরসভা ও নারায়ণগঞ্জের তারাব পৌরসভায় এটি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে জুলাই ২০২৩ থেকে জুন ২০২৮ মেয়াদে পাঁচ বছরে বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার বিভাগ।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কানসাটে ‘ক্যান্সার সচেতনতা: স্বাস্থ্যই সম্পদ’ সেমিনার অনুষ্ঠিত

এদেশে পিআর পদ্ধতি সম্পর্কে মানুষের ধারণা নেই : সেলিমুজ্জামান

নিহত যুবদল নেতা রাহুল সরকারের পরিবারের পাশে তারেক রহমান 

সাংবাদিকতা ও মিডিয়ার সেরাদের অ্যাওয়ার্ড দেবে ডিজিটাল মিডিয়া ফোরাম (ডিএমএফ)

সহজ ম্যাচ ঘাম ঝড়িয়ে জিতল বাংলাদেশ

ফ্লোটিলায় ইসরায়েলের হামলা / শুক্রবার বিক্ষোভ মিছিল করবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ

ছিনতাইকারীর ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মালয়েশিয়া প্রবাসী আহত

বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন!

সুপারির বাম্পার ফলন, লাভের মুখ দেখছেন চাষিরা

প্রতিমা বিসর্জনেও ‘ফিলিস্তিন মুক্তির’ প্রার্থনা

১০

মধ্যরাত থেকে মেঘনা নদীতে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা

১১

ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক মারা গেছেন

১২

গণঅভ্যুত্থানে সাংবাদিকদের কার্যক্রমকে অস্বীকার, বাগছাস নেতাকে আলটিমেটাম

১৩

এনসিপি থেকে আরও ২ নেতার পদত্যাগ

১৪

দেশকে উন্নতির শিখরে নিতে একযোগে কাজ করতে হবে : শিমুল বিশ্বাস

১৫

বোনের চল্লিশার মুরগি আনতে গিয়ে সড়কে গেল ভাইয়ের প্রাণ

১৬

ছাত্রদলে যোগ দিলেন ইউনিয়ন শিবির সভাপতি

১৭

গবেষণালব্ধ বই যুগের আলোকবর্তিকা : ধর্ম উপদেষ্টা 

১৮

মামলা দিয়ে হয়রানির প্রতিবাদে সড়কে স্থানীয়রা

১৯

দুর্গাপূজায় ডিউটিরত আনসার কমান্ডারের মৃত্যু

২০
X