শনিবার, ২৩ আগস্ট ২০২৫, ৮ ভাদ্র ১৪৩২
এ জেড ভূঁইয়া আনাস
প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:৫১ এএম
আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:২৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

উচ্চ সুদে ধার করে চলছে ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন
উচ্চ সুদে ধার করে চলছে ব্যাংক

আর্থিক অনিয়ম আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচন নীতির কারণে ভয়াবহ তারল্য সংকটে পড়েছে দেশের ব্যাংক খাত। সংকট সামাল দিতে আন্তঃব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। রেকর্ড সুদহার থাকার পরও বাড়ছে ধার। গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেকর্ড ২৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকারও বেশি ধার করেছে কয়েকটি ব্যাংক। পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আন্তঃব্যাংক কলমানি থেকেও ধার করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত বছরের শেষের দিকে ঋণ কেলেঙ্কারিসহ নানা কারণে কিছু কিছু ব্যাংকের তারল্য সংকট দেখা দেয়। ওই সংকট এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি ব্যাংকগুলো। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ না পেয়ে সরকারের বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ বাড়িয়ে দেওয়া, ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া, বিতরণ করা ঋণ থেকে ব্যাংকগুলো কোনো অর্থ ফেরত না পাওয়ায় তারল্য সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বুধবার সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে ২৪ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা স্বল্পমেয়াদি ধার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি ব্যাংকগুলো আন্তঃব্যাংক রেপো থেকে ধার নিয়েছে ১ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া কলমানি থেকে একই দিন ব্যাংকগুলো ধার করেছে ৪ হাজার ২৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক দিনে ব্যাংক ও সংকটে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ধারের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা।

ব্যাংকাররা বলছেন, সরকারের বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বাড়ার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ কমছে। তবে সরকারকে দেওয়া ঋণে তহবিল ব্যয় কম এবং কোনো ঝুঁকি নেই। এখন মুনাফাও বেশি। তাই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও সরকারকে সাধ্যমতো ঋণ দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো ব্যাংক ঋণ করে হলেও সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিল ও বন্ডের বিনিময়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। একই সময়ে আন্তঃব্যাংক রেপো থেকে ধার নিয়েছে ২০ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া আন্তঃব্যাংক কলমানি থেকে এক দিনের ধারের পরিমাণ ছিল ৫৫ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। এক কথায় উচ্চ সুদ থাকার পরও ব্যাংকগুলোকে তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনায় প্রতিদিনই বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ধার করতে হচ্ছে। যদিও এসব ধার থেকে সরকারকেও ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, বর্তমানে রেপো রেটের চেয়ে সরকারের বিল-বন্ডে সুদের হার বেশি। কভিডের আগে এমন পরিস্থিতি ছিল না। সে সময়ে রেপো রেটের চেয়ে বিল-বন্ডের সুদের হার কম ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো অভ্যন্তরীণ লেনদেনের জন্য বিল-বন্ড কেনার বিকল্প নেই। কারণ কোনো ব্যাংকের যদি আন্তঃব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করতে হয়, তাহলে তাকে সহ-জামানত হিসেবে বিল-বন্ড রাখতে হয়। এ ছাড়া ব্যাংকের এসএলআর রাখার ক্ষেত্রেও বিল-বন্ড ব্যবহার করতে হয়।

জানতে চাইলে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ডলার বিক্রি, আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকোচন নীতির কারণে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট বেড়েছে। এ মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে সংকোচন নীতি থেকে সরে আসা সম্ভব নয়। তাই তারল্য সংকট কাটাতে ডলার বাজার ও ব্যাংকের সুশাসনের দিকে নজর দেওয়ার বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়িয়ে ডলার বাজারকে স্থিতিশীল করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া ব্যাংক খেলাপিদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি নতুন করে যাতে ব্যাংকে কোনো ধরনের অনিয়ম না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে।

ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট থাকায় হুহু করে বাড়ছে আন্তঃব্যাংক কলমানি রেটের সুদের হার। গত ১১ বছরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো ধার বাড়িয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গতকাল বৃহস্পতিবার কলমানিতে সুদের হার বেড়ে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৫০ শতাংশে উঠেছে। সর্বনিম্ন হার ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। আর একই সময়ে গড় সুদের হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ১৪ শতাংশ। এটি গত ১০ বছর ১০ মাসে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১২ সালে কলমানিতে গড় সুদের হার উঠেছিল ১২ দশমিক ৮২ শতাংশ।

এদিকে গ্রাহকদের জমা টাকার সুরক্ষার জন্য ব্যাংকগুলোকে আমানতের ১৩ শতাংশ অর্থ বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখতে হয়। আর তা সংরক্ষণ করতে হয় সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ড কেনার মাধ্যমে। সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো এই শর্ত পরিপালনে বরাবরের মতোই ব্যর্থ হচ্ছে। এজন্য প্রতিনিয়তই জরিমানা গুণতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। গত আগস্টে ইসলামী ধারার ছয়টি ব্যাংক এসএলআর সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়। এজন্য ব্যাংকগুলোকে ৫৩ হাজার থেকে ২৬ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা গুণতে হয়েছে। একই ভাবে গ্রাহকের আমানতের নিরাপত্তার জন্য ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকে সাড়ে ৩ শতাংশ হারে নগদ অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জমা রাখতে হয়। আর প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোকে রাখতে হয় সাড়ে ৫ শতাংশ। এই ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও বা সিআরআর সংরক্ষণেও গত আগস্টে ব্যর্থ হয়েছে ইসলামী ধারার ছয়টি ব্যাংক। এমনকি সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণে ব্যর্থ ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ ধার নিয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। এজন্য ব্যাংকগুলোকে দ্রুত এসব ধারের পাশাপাশি সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণের জন্য তাগিদ দিয়ে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণে সুদের হার বাড়ানোর নীতিগ্রহণ করা হয়েছে। এ হার বাড়িয়ে বাজারে টাকার প্রবাহে লাগাম টেনে মূল্যস্ফীতির হার কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এ কারণে সব খাতেই ঋণের সুদ হার বাড়ছে। এরই মধ্যে সরকারের ঋণ গ্রহণের ট্রেজারি বিলের সুদের হারও বাড়ানো হয়েছে। এর প্রভাবে কলমানির সুদের হারও বেড়েছে।

তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সূত্র জানায়, আগে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকট মোকাবিলা করতে কলমানি মার্কেট থেকে এক দিনের জন্য ধার করত। পরের দিন তা সমন্বয় করে দিত। এখনো তাই করছে। তবে ব্যাংকগুলো এখন কলমানির পাশাপাশি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ধারও করছে বেশ। এসব অর্থ সহসা ফিরে আসছে না বাজারে। যে কারণে কলমানিতে ধার দেওয়ার সক্ষমতা অনেক ব্যাংকের কমেছে। তবে ধার করার প্রবণতা বেড়েছে।

গেল বছর তৈরি হওয়া আর্থিক সংকটের প্রভাব এখানো অব্যাহত রয়েছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের বিভিন্ন নীতির ভুলে কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না মূল্যস্ফীতি। এতে সংসার চালাতে মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। পাশাপাশি খরচের তুলনায় আয় না বাড়ায় ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধিও কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় চলতি বছরের অক্টোবরে আমানতের প্রবৃদ্ধি মাত্র ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ। যদিও এই প্রবৃদ্ধি পূর্বের আমানতের মুনাফার চেয়ে কম বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

এদিকে সংকোচন নীতির কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারছে না সরকার। উল্টো আগের করা ঋণও পরিশোধ করতে হচ্ছে। তাই বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বাড়িয়েছে সরকার। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (১ জুলাই-২৯ নভেম্বর) বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ৩১ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। একই সময়কালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নেওয়া হয়নি, উল্টো আগের নেওয়া ঋণের ২৭ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। সব মিলিয়ে, সরকারের নিট ব্যাংক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা। বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নেওয়া সরকারের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬৭ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেওয়া ব্যাংক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার ৪ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণের স্থিতি ৩ লাখ ৯৭ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা।

সম্পাদনা: রাসেল

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত: রাষ্ট্রদূত আনসারী

লা লিগার কাছে যে অনুরোধ করতে চায় বার্সা

‘নির্বাচনে আমলাদেরকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে’

সাবেক এডিসি শচীন মৌলিক কারাগারে

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা আসছেন শনিবার, যেসব বিষয়ে আলোচনা

সিদ্ধিরগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের শানে রিসালাত সম্মেলন

শেষ দিনেও ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে মতামত দেয়নি ৭ রাজনৈতিক দল

ইউরোপের লিগগুলোতে দল কমানোর প্রস্তাব ব্রাজিল কোচ আনচেলত্তির

নেপালে মার্কিন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের প্রচার, তাসনিম জারার ব্যাখ্যা

মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে মৃত্যুর মিছিল, তিন বছরে প্রাণ হারান ১৮৩ জন

১০

স্বর্ণ ব্যবসায়ীর বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি 

১১

সুদ দিতে না পারায় বসতঘরে তালা, বারান্দায় রিকশাচালকের পরিবার

১২

দেশ বাঁচাতে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে : চরমোনাই পীর

১৩

এএসপির বাসায় চাঁদাবাজি-ভাঙচুর, যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

১৪

জেলের জালে বড় ইলিশ, ৯ হাজারে বিক্রি 

১৫

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন নিয়ে নতুন নির্দেশনা

১৬

আগামী সংসদ প্রথম তিন মাস ‘সংবিধান সংস্কার সভা’ হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব

১৭

ধরলার তীব্র ভাঙন, টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি

১৮

নেতা ও ভোটারের জবাবদিহিই হবে শ্রেষ্ঠ সংস্কার : মঈন খান

১৯

পাপের ফল ওদের ভোগ করতেই হবে : রাশেদ খান

২০
X