বিএনপি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বয়কট করলেও এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কেটেছে দলটির অভ্যন্তরীণ সন্দেহ-অবিশ্বাস। কারণ, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে অল্প কিছু নেতা ভোটে গেলেও বাকিরা বিশেষ করে সিনিয়র নেতারা হাইকমান্ডের প্রতি ছিলেন পুরো অনুগত। এটাকে এক ধরনের সফলতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। অথচ নির্বাচনের আগে দল ও রাজনৈতিক অঙ্গনে জোর গুঞ্জন ছিল, বিএনপি ভোট বর্জন করলেও দলটির সিনিয়র অনেক নেতা স্বতন্ত্র কিংবা অন্য দল থেকে নির্বাচন করবেন। এতে করে ভোটকে ঘিরে দলে ভাঙন স্পষ্ট হতে পারে। কারণ, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আইনগত ও অসুস্থতাজনিত অনুপস্থিতিতে দল পরিচালনা নিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতি সিনিয়র নেতারা অসন্তুষ্ট। এ ছাড়া হাইকমান্ডের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার সঙ্গে রাজনীতি করা এসব নেতাকে দলে নানাভাবে অবমূল্যায়ন করার অভিযোগও ছিল। নির্বাচনের আগে মহাসচিবসহ সিনিয়র ও গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতা গ্রেপ্তার হলেও দলের সঙ্গে বেইমানি করেননি, ভোটেও যাননি। এর মধ্য দিয়ে দলে তারেক রহমানের নেতৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে মনে করছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
দীর্ঘ অসুস্থতা এবং আইনি বাধ্যবাধকতায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাজনীতির মাঠের বাইরে রয়েছেন। এ কারণে দল পরিচালনায় কোনো বিষয়ে সাধারণত তিনি সিদ্ধান্ত দেন না। সংগ কারণেই খালেদা জিয়ার এমন অনুপস্থিতিতে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হওয়া তারেক রহমান আদালত থেকে জামিন নিয়ে চিকিৎসার জন্য ২০০৮ সালে সপরিবারে যুক্তরাজ্য যান। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া একটি দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাগারে গেলে ওইদিন রাতেই এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তারেক রহমানকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়। বর্তমানে লন্ডনে থেকে দল পরিচালনা করছেন তিনি। একপর্যায়ে খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখেই দলীয় সরকারের অধীনে ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিএনপি; কিন্তু নির্বাচনে ভরাডুবির পর ঘুরে দাঁড়াতে সংগঠন গোছানোয় মনোযোগ দেয় দলটি। পরবর্তী নির্বাচন ও আন্দোলন সামনে রেখে তখন থেকেই অত্যন্ত আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ত নেতাদের দায়িত্বে আনেন তারেক রহমান।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের অনেক আগেই নির্বাচন নিয়ে দলীয় অবস্থান স্পষ্ট করে বিএনপি। সংগঠন গুছিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে দলটি। এরপর গত ১২ জুলাই থেকে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে আন্দোলনে নামে। নির্বাচন বয়কট করে দাবি আদায়ে ২৯ অক্টোবর থেকে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর আন্দোলন শুরু করে দলটি। বিএনপিসহ যুগপতের মিত্রদের আন্দোলনের মধ্যেই গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এদিকে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অঙ্গনে জোর গুঞ্জন ছিল, বিএনপি নির্বাচন বয়কট করলেও দলটির অনেক নেতা স্বতন্ত্র কিংবা অন্য দল থেকে নির্বাচন করবেন। বিশেষ করে নির্বাচন ঘিরে নিবন্ধন পাওয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) এবং তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়ে বিএনপির এক থেকে দেড়শ নেতা ভোট করবেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলটির ৪০ জনের মতো নেতা নির্বাচনে যান। এর মধ্যে বিএনপির কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতা এবং সাবেক সংসদ সদস্য ছিলেন। বিএনএম ও তৃণমূল বিএনপি থেকে ১১ জন সাবেক এমপি ভোট করেন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন বিএনপির। তবে তারা কেউ ডাকসাইটের নেতা নন। উল্লেখযোগ্য নেতাদের মধ্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নৌকা প্রতীকে এবং চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এস এ কে একরামুজ্জামান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোট করেন। নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে নির্বাচনের আগে জামিনে কারামুক্ত হয়েই আওয়ামী লীগে যোগ দেন শাহজাহান ওমর।
এ ছাড়া বিএনপির আলোচিত প্রার্থীদের মধ্যে বহিষ্কৃত নেতা মেজর (অব.) আক্তারুজ্জামান, বহিষ্কার হওয়া ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ, সাবেক এমপি ডা. জিয়াউল হক মোল্লা, বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক উপদেষ্টা মোহাম্মদ শোকরানা নির্বাচন করেন। এদিকে নির্বাচনের আগে তৃণমূল বিএনপিতে যোগদান করে ভোট করেন বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বহিষ্কার হওয়া তৈমূর আলম খন্দকার। অন্যদিকে নির্বাচনের আগে বিএনএমে যোগদান করে ভোট করেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য ও দলের সাবেক এমপি শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর। তবে তাদের মধ্যে কেবল শাহজাহান ওমর ও একরামুজ্জামান বিজয়ী হন। ভোটের আগে দল ও রাজনৈতিক অঙ্গনে জোর গুঞ্জন ছিল, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ দল ছেড়ে বিএনএমের চেয়ারম্যান হয়ে ভোট করবেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বিএনপির সঙ্গেই থেকেছেন।
এদিকে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ভোটে যাওয়ায় নেতাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে চিহ্নিত করে সঙ্গে সঙ্গেই সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে বিএনপি। তাদের দলে ফিরিয়ে নেওয়ার ন্যূনতম কোনো আগ্রহও নেই। যদিও নির্বাচন ঘিরে বহিষ্কৃতরা দলে ফিরতে চান, এমন কোনো কথা তারা এখনো বলেননি। তবে ভবিষ্যতে ভুল স্বীকার করে দলে ফিরতে আবেদন করলেও তাদের জন্য বিএনপির দরজা সহসাই খুলবে না। দলটির নেতারা বলছেন, তারা জেনে-শুনে-বুঝে বিএনপির সঙ্গে বেইমানি করেছেন। বেইমানির ফলও তারা পেয়েছেন।
বিএনপির বছরব্যাপী আন্দোলন চূড়ান্ত সফলতা না পেলেও শাহজাহান ওমর ও একরামুজ্জামান ছাড়া পদধারী উল্লেখযোগ্য কারোর ভোটে না যাওয়াকে দলটির জন্য এক ধরনের সফলতা হিসেবে দেখছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী কালবেলাকে বলেন, অনেকে মনে করেছিল, সিনিয়র নেতারা তারেক রহমানের নেতৃত্বের প্রতি তেমন আস্থাশীল না। এমন অবস্থায় এবার ভোটে না গেলে বিএনপি হয়তো ভেঙে যাবে; কিন্তু আন্দোলন সামনে রেখে তারেক রহমান এবার খুব সুন্দর স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেন। দলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তৃণমূল পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়ান তিনি। ফলে একেবারে তৃণমূল থেকে দলটাকে একটা সফল রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন। সে কারণে আমরা দেখেছি, আন্দোলনে সিনিয়র নেতাদের যত না সক্রিয় ভূমিকা ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ভূমিকা ছিল তৃণমূল থেকে উঠে আসা মধ্যম পর্যায়ের নেতাদের। তবে এটা সত্য, নানা কারণে বিএনপির আন্দোলন চূড়ান্ত সফলতা পায়নি। পাশাপাশি এটাও সত্য যে, সরকারি নানা চাপ ও প্রলোভন সত্ত্বেও একমাত্র শাহজাহান ওমর ছাড়া পদধারী উল্লেখযোগ্য কেউ ভোটে যাননি। এখানেই বিএনপির সফলতা।