উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা। দেশে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের প্রধান তিনটি কারণের একটি এই রোগ। একসময় উচ্চ রক্তচাপের রোগী শহরকেন্দ্রিক হলেও নগরায়ণের প্রভাবে এখন গ্রামেও বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। অনিয়মিত ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং অপর্যাপ্ত শারীরিক শ্রমকে এর জন্য দায়ী করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, শর্করা জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া, জাঙ্ক ফুড, প্রচুর পরিমাণে লবণ ও চিনি খাওয়া, মদ ও ধূমপান এবং পর্যাপ্ত কায়িক শ্রম না করাই উচ্চ রক্তচাপের জন্য দায়ী। শুধু বিস্তার নয়, স্থানীয় পর্যায়ে সুযোগ-সুবিধার অভাবে রোগটি দেরিতে শনাক্ত হচ্ছে এবং আক্রান্ত ব্যক্তিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। চিকিৎসকরা বলছেন, গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে ১৪ হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও সচেতনতার অভাব রয়েছে। আবার সব ক্লিনিকে রোগটি স্ক্রিনিংয়ের সুযোগও নেই। তাই নীরব ঘাতক হিসেবেই থেকে যাচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ। তবে স্ক্রিনিং জোরদার করে সেবার আওতা বাড়ানো হলে ২০৫০ সালের মধ্যে ৭ দশমিক ৬ কোটি মৃত্যু এড়ানো সম্ভব।
মাদারীপুরের শিবচরের বাসিন্দা আসমা আক্তার। ৪২ বছরের এই নারী গত মঙ্গলবার এসেছেন রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, দীর্ঘদিন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছি। প্রায়ই অস্থির লাগত। স্থানীয় ক্লিনিকে পরীক্ষায় উচ্চ রক্তচাপের পাশাপাশি ডায়াবেটিসও ধরা পড়ে। এরপর এখানে চিকিৎসা শুরু করি। বারডেমের চিকিৎসকরা বলছেন, উচ্চ রক্তচাপের কারণেই এখন ডায়াবেটিস হয়েছে।
শুধু আসমা নন, দেশের জনসংখ্যার প্রায় ২৭ শতাংশ অর্থাৎ ৪ কোটি মানুষ ভুগছেন উচ্চ রক্তচাপে। এর বড় অংশই গ্রামাঞ্চলের। তবে শহর কিংবা গ্রাম যেখানেই হোক, সিংহভাগ আক্রান্তই জানেন না তারা এ নীরব ঘাতকের শিকার। যখন জানতে পারেন, তখন ওই রোগের পাশাপাশি ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ আরও নানা জটিলতা নিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান।
চিকিৎসকরা বলছেন, শহরাঞ্চলে চলাচলের পথ সীমিত হওয়ায় অধিকাংশ সময়ে যানবাহন ব্যবহার করে মানুষ। আবার যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় গ্রামাঞ্চলেও কম দূরত্বের পথেও না হেঁটে বাহন ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে। সেখানেও অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের প্রভাব পড়ছে। অতিরিক্ত ওজন, ধূমপান ও মাদকের প্রভাবও বেড়েছে। সঙ্গে নানা কারণে কমছে শারীরিক পরিশ্রম।
গত বছর সেপ্টেম্বরে উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সেখানে বলা হয়, বিশ্বের ৩০ থেকে ৭৯ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর ৩৩ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। গত ত্রিশ বছরে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে ১৩০ কোটি। এর মধ্যে ৭৮ শতাংশই বাংলাদেশসহ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর অধিবাসী। বাংলাদেশের চিত্র খুবই উদ্বেগজনক বলেও মন্তব্য করেছে ডব্লিউএইচও। সংস্থাটির গ্লোবাল রিপোর্ট অন হাইপারটেনশন ২০২৩ এ বলছে, বাংলাদেশে আক্রান্তদের ৫৬ শতাংশই তাদের রোগ সম্পর্কে অবগত নন। তাদের চিকিৎসাসেবা গ্রহণের হার খুবই কম। মাত্র ৩৮ শতাংশ চিকিৎসা নেন। যার মধ্যে নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে মাত্র ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ ওষুধ সেবনের পরও রোগটি নিয়ন্ত্রণে নেই ৮৫ শতাংশেরই। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ২ লাখ ৭৩ হাজার মানুষ হৃদরোগজনিত অসুস্থতায় মারা যায়, যার ৫৪ শতাংশের জন্য দায়ী উচ্চ রক্তচাপ। তবে সেবার আওতা বাড়ালে ২০৫০ সালের মধ্যে ৭ দশমিক ৬ কোটি মৃত্যু এড়ানো সম্ভব।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে সাম্প্রতিক কোনো গবেষণা নেই সরকারের কাছে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৭ অনুযায়ী, দেশের প্রায় ২৭ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। সংখ্যায় ৪ কোটির বেশি। এর মধ্যে অতিরিক্ত ওজনের নারী-পুরুষের রোগটিতে আক্রান্তের হার যথাক্রমে ৪৯ ও ৪২ শতাংশ। আর স্বাভাবিক ওজনের নারী-পুরুষের হার যথাক্রমে ২৫ ও ২৪ শতাংশ। সার্ভের ফল অনুযায়ী, প্রতি ১০টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সাতটিতে উচ্চ রক্তচাপজনিত চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। তবে নির্ণয় ও ব্যবস্থাপনা গাইডলাইন রয়েছে মাত্র ১৭ ভাগে। প্রশিক্ষিত কর্মী রয়েছে মাত্র ২৯ শতাংশে। গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডি (জিবিডি) ২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের প্রধান তিনটি কারণের একটি উচ্চ রক্তচাপ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, নগরায়ণের ফলে বর্তমানে উচ্চ রক্তচাপের রোগী সবখানেই। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের পাশাপাশি হাঁটাচলার প্রবণতা কমেছে। বার্গার, হাই এনার্জি ড্রিংকস থেকে শুরু করে অস্বাস্থ্যকর সব খাবার গ্রামের দোকানেও পাওয়া যাচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ মোকাবিলায় সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে মডেল এনসিডি কর্ণার করা হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকে ডায়াবেটিস ও প্রেশারের ওষুধের সঙ্গে ব্লাড প্রেশার ও সুগারও মাপা যাচ্ছে। তবে এখনো ডায়াগনোসিস শুরু হয়নি। সে পর্যায়ে যেতে আলাদা লোকবল লাগবে।
গত বছর ১৪ মে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের (সিসিএইচএসটি) ওষুধের তালিকা হালনাগাদকরণ কমিটি সভায় কমিউনিটি ক্লিনিকের ওষুধ তালিকায় উচ্চ রক্তচাপের জন্য এমলোডিপিন ৫ মিলিগ্রাম ও ডায়াবেটিসের জন্য মেটফরমিন ৫০০ মিলিগ্রাম সরবরাহের সিদ্ধান্ত হয়। তৃণমূল পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ ঠেকাতে এটিকে যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের এপিডেমিওলোজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, অর্থনৈতিক পরিবর্তনে গ্রাম-শহরে উভয় স্থানেই মানুষের দৈনন্দিন জীবনেও পরিবর্তন এসেছে। রাস্তাঘাটসহ সবকিছুর উন্নয়নে সবাই হাঁটাচলা কমিয়েছে। অল্প দূরত্বেও যানবাহন ব্যবহার করছে আবার ক্যালোরি বেশি খাচ্ছে, ফলে ওজন বাড়ছে। গ্রামেও প্রসেসড ফুড (প্রক্রিয়াজাত খাবার) খাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। সঙ্গে আছে মাত্রাতিরিক্ত লবণ খাওয়া। এ ছাড়া তামাক ও মদপানও দায়ী। এসব করেই শরীরে বাসা বাঁধছে উচ্চ রক্তচাপ। এ কারণে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগও।
তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হলো, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত অর্ধেকেরও বেশি মানুষ তার রোগ সম্পর্কে জানে না। কারণ, এটির কোনো উপসর্গ নেই। কেউ স্ক্রিনিং না করলে রোগটি সম্পর্কে অজানাই থেকে যাবে। এজন্য বারবার স্ক্রিনিংয়ে জোর দিচ্ছি। বছরে অন্তত একবার উচ্চ রক্তচাপ মাপা দরকার।