সরকারবিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি দল গোছানোর কাজও এগিয়ে নিতে চায় বিএনপি। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে জাতীয় নির্বাহী কমিটির শতাধিক শূন্য পদ পূরণের উদ্যোগ নিয়েছে দলটি। ইতোমধ্যেই সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক পদে একজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্য পদগুলোও পূরণ করা হবে। এসব পদে জায়গা পেতে তৎপর রয়েছেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের শতাধিক সাবেক নেতা। বিগত আন্দোলন সংগ্রামে যারা রাজপথে কিংবা নেপথ্যে থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তারা এখন নিজেদের মূল্যায়ন আশা করছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, নির্বাচনের পর জোরালো কোনো কর্মসূচি না দিলেও সরকারবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যেতে চান বিএনপি নেতারা। আপাতত রুটিন কর্মসূচির পাশাপাশি কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে দল গোছানোর কাজ এগিয়ে নিতে চান তারা। এরই ধারাবাহিকতায় পরিস্থিতি বুঝে দলের জাতীয় কাউন্সিল আয়োজনও করবে বিএনপি। সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই কেন্দ্রীয় কমিটির শূন্য পদ পূরণ করা হচ্ছে।
অনেকের মতে, বিএনপিতে বেশ কিছু নেতাকে অতিমূল্যায়ন আবার কাউকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। অতীতে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা হিসেবে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও অনেকেই কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা পাননি। আবার কেউ কেউ একাধিক পদ আঁকড়ে রেখেছেন। বেশ কয়েকজন নেতা কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এবং জেলা পর্যায়ে সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। এ কারণে বিএনপিতে ‘এক নেতা এক পদ’ নীতি কার্যকর হচ্ছে না। যথাযথভাবে এটি বাস্তবায়ন হলে অনেক ত্যাগী নেতাকে মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে।
নির্বাহী কমিটির অবস্থা: ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলন। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলটির কেন্দ্রীয় কমিটিতে মোট পদের সংখ্যা ৫৯২। সম্মেলনের প্রায় পাঁচ মাস পর কেন্দ্রীয় কমিটির ৪৯৬ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। সেখানে অনেক তরুণ, নতুন মুখ এবং নারীকে জায়গা দেওয়া হয়। পদ পান ছাত্রদলের শতাধিক সাবেক নেতা।
তবে গত সাত বছরে কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক নেতা মারা গেছেন। নানা কারণে বাদ পড়েছেন কেউ কেউ। ফলে কেন্দ্রীয় কমিটির উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পদ বর্তমানে খালি রয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির পাঁচটি পদ শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যানের ১৭, উপদেষ্টা পরিষদের ১৭ এবং সম্পাদক ও সহসম্পাদক মিলিয়ে আরও প্রায় একশর মতো পদ খালি রয়েছে।
বিএনপির একাধিক নেতা জানান, দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বার্ধক্য, অসুস্থতাসহ নানা কারণে এখন ৮-১০ জনের বেশি সদস্য উপস্থিত থাকেন না। নির্বাহী কমিটির অনেক সদস্যও অসুস্থতা ও বয়সজনিত কারণে নিষ্ক্রিয়। অনেকেই জেলা পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করায় কেন্দ্রে সময় দিতে পারেন না। আবার কেউ কেউ কেন্দ্রে থাকলে এলাকায় সময় দিতে পারেন না। ফলে নির্বাহী কমিটির শূন্য পদগুলো পূরণ এবং ‘এক নেতা এক পদ’ নীতি কার্যকর করা সময়ের দাবি।
জানা গেছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে শুরুতে দুটি পদ খালি ছিল। পরে এমকে আনোয়ার, তরিকুল ইসলাম, আ স ম হান্নান শাহ ও মওদুদ আহমদ মারা গেলে শূন্য পদ হয় ছয়টি। সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান পদত্যাগ করায় শূন্য পদ দাঁড়ায় সাতে। পরে সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করায় শূন্য পদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫।
জানা গেছে, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় বিএনপির হাইকমান্ড শিগগির স্থায়ী কমিটির শূন্য পদ পূরণের উদ্যোগ নিতে পারেন। সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামে যুক্ত হতে পারেন, এমন কয়েকটি নাম নিয়ে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনাও রয়েছে। আলোচিত নেতারা হলেন আব্দুল্লাহ আল নোমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, বরকতউল্লা বুলু, মো. শাহজাহান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, নিতাই রায় চৌধুরী, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, আহমেদ আযম খান, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন, শামসুজ্জামান দুদু ও রুহুল কবির রিজভী। এ ছাড়া যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও সাবেক এমপি জহির উদ্দিন স্বপনের নামও আলোচনায় আছে। তবে তাদের মধ্যে ডা. জাহিদ হোসেন, আহমেদ আযম খান, জয়নুল আবেদিনকে পেশাজীবী নেতা হিসেবেই বিবেচনা করেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। দলীয় কাউন্সিলের পর আব্দুল্লাহ আল নোমান স্থায়ী কমিটিতে জায়গা না পাওয়া সবাইকে বিস্মিত করে। হাফিজ উদ্দিন আহমদ অতীতে দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও ওয়ান-ইলেভেনে ভূমিকা এবং সাম্প্রতিক কিছু মন্তব্যের কারণে বিতর্কিত হন।
গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন শুরু:
সূত্র জানায়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি দলের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নেতাকর্মীদের মনোবল ধরে রাখতে নির্বাহী কমিটির শূন্য পদ পূরণ এবং যেসব জেলা ও মহানগরে আংশিক কমিটি রয়েছে, তা পূর্ণাঙ্গ করতে তাকে পরামর্শ দিয়েছেন সিনিয়র নেতারা। সক্রিয় নেতাদের ‘যোগ্যতা ও ত্যাগ’ বিবেচনায় মূল্যায়নের পরামর্শ দেন তারা। পাশাপাশি রাজপথে কর্মসূচিতে সক্রিয় হওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপরই গত ১১ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইয়েদুল ইসলাম বাবুলকে ঢাকা বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়।
এর আগে গত বছর বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল করা হয়। পাশাপাশি কারাগারে থাকায় ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক ও দক্ষিণের সদস্য সচিব হিসেবে দুজনকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়।
মূল্যায়নের অপেক্ষায় সাবেক ছাত্রনেতারা:
জানা গেছে, অতীতে আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় যেসব নেতা পদবঞ্চিত ও অবমূল্যায়িত হয়েছেন, তারা আগামীতে তাদের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন চান। বিশেষ করে ছাত্রদলের সাবেক নেতারা দলের হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।
পদপ্রতাশ্যীদের অভিযোগ, ছাত্রদলের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তারা নানাভাবে হামলা, মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। হয় রাজপথ, না হয় জেলখানায় থেকেছেন। ছাত্র রাজনীতি থেকে বিদায়ের পর তাদের অনেককেই বিএনপি যথার্থ মূল্যায়ন করেনি। দলীয় কোনো পদ-পরিচয় না থাকায় কেউ কেউ এখন অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন। দীর্ঘদিন পদবঞ্চিত থাকায় ক্ষোভে-দুঃখে অসুস্থ হয়ে ভারতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মনির হোসেন। রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও অনেকেই দলের বড় কোনো কর্মসূচি থাকলে সেখানে ছুটে আসেন। আগামীতে বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের কমিটিতে পদ পেয়ে ফের সক্রিয়ভাবে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখতেন সাবেক এই ছাত্রনেতারা।
মূল্যায়নের প্রত্যাশায় থাকা সাবেক ছাত্রনেতারা হলেন- গোলাম সারোয়ার, ওয়াহিদ বিন ইমতিয়াজ বকুল, আবুল কালাম আজাদ, রফিক হাওলাদার, ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, শাহাবুদ্দিন আহমেদ মুন্না, আশরাফ উদ্দিন আহমেদ রুবেল, আহসান উদ্দিন খান শিপন, আব্দুল হালিম খোকন, জাকির হোসেন মিজান, আবু তাহের পাটোয়ারী, পারভেজ আল বাকি, রফিকুল ইসলাম রফিক, শহীদুল্লাহ ইমরান, মো. এজমল হোসেন পাইলট, ইখতিয়ার রহমান কবির, মামুন বিল্লাহ, জয়দেব জয়, আসাদুজ্জামান আসাদ, বায়েজিদ আরেফিন, দবির উদ্দিন তুষার, গোলাম আজম সৈকত, আবুল বাসার সিদ্দিকী, আব্দুল মালেক, আজিজুল হক পাটোয়ারী আজিম, তারেক উজ জামান, শোয়াইব খন্দকার, আশরাফুর রহমান বাবু, হুমায়ুন কবির, সাজ্জাদ হোসেন উজ্জ্বল, জাকির হোসেন খান, মিজানুর রহমান সোহাগ, সামসুল আলম রানা, এবিএম মহসিন বিশ্বাস, এসএম রাসেল, মাহবুব সিকদার, আনোয়ার জাহিদ, কাজী মেজবাহুল আলম, সৈয়দ আবেদিন প্রিন্স, হাফিজুর রহমান শরিফ, সাইদুর রহমান রয়েল, কোয়েল হোসেন, রকিবুল হাসান হাওলাদার, শফিউল আজম, শহিদুল ইসলাম, মাসুদ সরকার, খোরশেদ আলম, খন্দকার রিয়াজ, মাজেদুল ইসলাম মাসুম, রবিউল হাসান আরিফ, জিল্লুর রহমান কাজল, আব্দুল ওয়াহাব, জহিরুল ইসলাম বিপ্লব, মির্জা ইয়াসিন আলী, রাশিদুল ইসলাম রিপন, মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক, রাজীব আহসান চৌধুরী পাপ্পু, আবুল হাসান, আনিসুর রহমান রানা।
এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কালবেলাকে বলেন, ‘সাবেক ছাত্রনেতাদের মূল্যায়নের ব্যাপারে বিএনপির হাইকমান্ড খুবই ইতিবাচক। ইতোমধ্যে বিএনপিসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনে ছাত্রদলের সাবেক নেতারা দায়িত্বে এসেছেন। আগামীতে যেসব অঙ্গসংগঠনের কমিটি হবে, সেগুলোতে তাদের সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করা হবে।’