সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী আরাফাত আমিন তমালকে (২২) গুলি করা সেই শিক্ষক ডা. রায়হান শরীফের হেফাজত থেকে আরও একটি বিদেশি পিস্তল, ৮১ রাউন্ড গুলি ও বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এদিকে শিক্ষক রায়হানের বিরুদ্ধে গুলিবিদ্ধ ছাত্রের পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যাচেষ্টা মামলা ও পুলিশের পক্ষ থেকে আরেকটি অস্ত্র মামলা করা হয়েছে। অন্যদিকে ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
আহত আরাফাত আমিন তমাল বগুড়া জেলার ধুনট থানার ধানসিঁড়ি নাটাইপাড়া এলাকার আবদুল্লাহ আল আমিনের ছেলে। তিনি শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। অভিযুক্ত ডা. সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার বিএ কলেজের রোডের প্রফেসর গার্ডেন এলাকার অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের ছেলে। তিনি ওই মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে সিরাজগঞ্জ ডিবি পুলিশের ওসি মো. জুলহাজ উদ্দীন জানান, সোমবার বিকেলে তৃতীয় বর্ষের আইটেম পরীক্ষা একাডেমি ভবনের চতুর্থ তলায় ডা. সামাউন নূর শুভর কক্ষে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। পরীক্ষা চলাকালে রায়হান শরীফ হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ছাত্রছাত্রীদের অহেতুক বকাবকি করেন। বকাবকির এক পর্যায়ে ব্যাগ থেকে পিস্তল বের করে এক ছাত্রকে গুলি করেন। গুলিটি ওই ছাত্রের (তমাল) ডান পায়ের উরুর ওপরের অংশে লেগে তিনি গুরুতর আহত হন। খবর পেয়ে সদর থানা পুলিশ ও ডিবির টিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ডা. রায়হান শরীফকে হেফাজতে নেয়। এ সময় শ্রেণিকক্ষের টেবিল থেকে একটি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র ও একটি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়।
ডিবির ওসি আরও বলেন, অভিযুক্তকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি তার লেদারের ব্যাগের ভেতর থেকে আরও একটি বিদেশি পিস্তল, ৮১ রাউন্ড তাজা গুলি, ৪টি ম্যাগাজিন, ২টি বিদেশি কাতানা (ছোরা) ও ১০টি অত্যাধুনিক বার্মিজ চাকু বের করে দেন। উদ্ধার হওয়া সব অস্ত্রই অবৈধ। তিনি বলেন, সোমবার রাত ১২টার দিকে আহত তমালের বাবা আবদুল্লাহ আল আমিন বাদী হয়ে সদর থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা করেন। অন্যদিকে ডিবির উপ-পরিদর্শক আবদুল ওয়াদুদ বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে অন্য একটি মামলা করেছেন। এসব মামলায় রায়হান শরীফকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। আদালতে তিনি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে ঘটনার দায় স্বীকার করেছেন। বিকেলে (গতকাল) সিরাজগঞ্জ অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. বেলাল হোসেনের আদালতে তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন। পরে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত।
এদিকে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মো. আমিরুল হোসেন বলেন, শ্রেণিকক্ষে ছাত্রকে গুলি করার ঘটনাটি তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এতে আহ্বায়ক করা হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজকে। কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক মো. মহিউদ্দিন মাতুব্বর এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ উপসচিব মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন। ইতোমধ্যে তদন্ত টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।
ডা. রায়হানের বিরুদ্ধে আরও যত অভিযোগ
শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা, অস্ত্র নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে প্রবেশসহ নানা অভিযোগ রয়েছে ডা. রায়হান শরীফের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ উঠলেও তাকে শাস্তি বা বদলির চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় কলেজ প্রশাসন।
শিক্ষার্থীরা বলেছেন, শিক্ষক রায়হান শরীফ উগ্র মস্তিষ্কের মানুষ। তিনি ছাত্র ও অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করেন। তিনি সবসময় ব্যাগে অস্ত্র ও ছোরা নিয়ে ঘুরতেন। ক্লাসে এসে অস্ত্র টেবিলের ওপর রেখে লেকচার দিতেন। ছাত্রছাত্রীরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ক্লাসে না আসতে বললে তিনি তাদেরও ভয়ভীতি ও গুলি করে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিতেন। সোমবার পরীক্ষা চলাকালে বিকেল ৩টার দিকে তিনি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ছাত্রছাত্রীদের অহেতুক বকাবকি করেন। এ সময় আমার একটি পোষা পাখি আছে–এ কথা বলেই তার ব্যাগ থেকে পিস্তল বের করেন। পিস্তল দেখিয়ে বলেন, এটাই আমার ‘পোষা পাখি’। পিস্তলটি নড়াচড়া করতেই গুলি বের হয়ে তমালের পায়ে লাগে। আরেক শিক্ষার্থী লাবিবার কানের পাশ দিয়ে যায়।
কলেজের শিক্ষার্থী সাদিয়া ও লাবিবা বলেন, শিক্ষক রায়হান শরীফ ছাত্রীদেরও উত্ত্যক্ত করতেন। আপত্তিকর ইশারা করতেন। ভয়ভীতিও প্রদর্শন করেন। এসব বিষয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষকে জানালেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
রায়হান শরীফের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন তার সহকর্মী শিক্ষকরাও। কলেজের ফরেনসিক ও মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবদুল্লাহ হিল কাফিসহ একাধিক শিক্ষক বলেন, শিক্ষক রায়হান শরীফ এর আগেও কলেজে পিস্তল নিয়ে এসেছিলেন। বিষয়টি নজরে আসার পর তাকে সতর্ক করায় তিনি উল্টো ভয় দেখিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন ও হোস্টেলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মাদক অফার করারও অভিযোগ রয়েছে। তাকে বেশ কয়েকবার বদলির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন কলেজ অধ্যক্ষ।
রায়হান শরীফের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন কলেজের অধ্যক্ষ আমিরুল হোসেন চৌধুরীও। তিনি বলেন, ওই শিক্ষক এক ধরনের সাইকো। তার মেজাজ সবসময় চড়া থাকে। মাঝে-মধ্যেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তার খারাপ আচরণের অভিযোগ পাওয়া যায়। তাকে বদলির জন্য কয়েকদফা চেষ্টা করেছি। অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েও বদলি করাতে পারিনি।
শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ছাত্রকে গুলি করার ঘটনায় ডা. রায়হান শরীফের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। তিনি কীভাবে কলেজ ক্যাম্পাসে পিস্তল নিয়ে ঢুকলেন বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
শ্রেণিকক্ষে ছাত্র আরাফাত আমিন তমালকে গুলি করা শিক্ষক ডা. রায়হান শরীফের শাস্তি, বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন বাতিল, সরকারি চাকরি থেকে স্থায়ী বহিষ্কারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনাসহ কয়েক দফা দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি ও বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীর। গতকাল দুপুরে সিরাজগঞ্জ-বগুড়া মহাসড়কে তারা বিক্ষোভ করেন। পরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গঠিত তদন্ত দলের সদস্যরা ওই শিক্ষকের শাস্তির আশ্বাস দিলে শিক্ষার্থীরা ফিরে যান।