গাজীপুরের কালিয়াকৈর তেলিরচালা এলাকায় গত ১৩ মার্চ বিকেলে গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ৩২ জন দগ্ধ হয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে একে একে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
গতকাল রোববার সরেজমিন তেলিরচালা এলাকার সেই গলিতে গিয়ে দেখা যায়, এখনো শোকের চাদরে ঢাকা পড়ে আছে এখানকার মানুষের জীবনধারা। এই গলির প্রত্যেক পরিবারই দুর্বিষহ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাদের কেউ মা-হারা, কেউ বাবা-হারা, কেউবা সন্তান হারিয়ে বুকে বিশাল শোকের পাথর চাপা দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। কয়েকদিন পরই ঈদ; কিন্তু তাদের মধ্যে নেই ঈদের আনন্দ। আছে শুধু অশ্রুসিক্ত এসব মানুষের করুণ গল্প, আছে আহাজারি আর বিলাপ।
অগ্নিদগ্ধ হয়ে যারা চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের স্বজনদের মধ্যে একজন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার তারুটিয়া গ্রামের শাহ আলম। তিনি মাত্র ১১ বছর বয়সী সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে রাব্বিকে হারিয়ে এখন দিশেহারা। তার চোখে যেন ঘুম নেই। দেড় বছর বয়সে মা হারায় রাব্বি। পরে তার বাবা শাহ আলম প্রতিষ্ঠিত করবে বলে কালিয়াকৈরের তেলিরচালা এলাকায় ভাড়া বাসায় থেকে আইসক্রিম বিক্রি করে ছেলেকে পড়ালেখা করিয়েছে। কিন্তু নিমিষেই হারিয়ে গেল শাহ আলমের স্বপ্ন। শাহ আলম বলেন, ‘আমাদের মাঝে কোনো আনন্দ নেই. আছে শুধু দুঃখ-বেদনা আর দুর্দশা। পবিত্র রমজান মাস কীভাবে যাচ্ছে তাও বলতে পারব না।’
এ ঘটনায় সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার ভেরা খোলা গ্রামের মো. হাসু খান তার ভাই ও ভাবি দুজনকেই হারিয়েছেন। ভাই মহিদুল ইসলাম খান ও স্ত্রী মারা গিয়ে রেখে গেছেন সাজেদ খান নামক তিন বছরের এক ছেলে সন্তান। বর্তমানে সাজেদ খান তার গ্রামের বাড়ি দাদা-দাদির কাছেই রয়েছে। হাসু খান বলেন, ‘এখন এই ভাতিজাকে নিয়ে আমরা কীভাবে কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। ছোট্ট একটা বাচ্চা এই বয়সে মা-বাবা হারাল, তাকে আমরা ঠিকঠাকভাবে লালন-পালন করতে সক্ষম হব কি না আল্লাহই ভালো জানেন।’
স্বামীহারা দোলী খাতুন তিন সন্তান নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন বিষণ্নতায়। অথচ কদিন আগেও স্বপ্ন দেখেছিলেন রমজান শেষ করে পরিবারের সবার জন্য নতুন পোশাক কিনে গ্রামে ফিরে ঈদ করবেন। সেই স্বপ্ন শেষ হয়েছে নিমেষেই। পুরো রমজান মাসেই তাদের কাছে বিষাদ লেগেছে।
আরেকজন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভালোযান গ্রামের শফিকুল ইসলাম। তিনি ছয় সন্তানের জনক ছিলেন। মা, স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে সাত সদস্যের পরিবার তার। একটি ছেলে জন্মের সময়ই মৃত্যুবরণ করে আর এই অগ্নিকাণ্ডে হারায় তার ৮ বছরের মাদ্রাসা পড়ুয়া আদরের সন্তান সোলায়মানকে। তিনি তার গ্রামের বাড়ি থেকে পাঁচ বছর আগে এসেছিলেন এই এলাকায়। সিদ্ধ ডিম বিক্রি করেই চলে তার সংসার। আদরের সন্তানকে হারিয়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে গোটা পরিবারে। ছেলের ছবি হাতে নিয়ে শফিকুল দাঁড়িয়ে থাকেন প্রায়ই। দুর্ঘটনার পর থেকে কোথাও থেকে কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন কি না—জানতে চাইলে শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ছেলে মারা যাওয়ার পর এক জায়গা থেকে ২০ হাজার টাকা মোবাইলে আর হাসপাতাল থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকা পেয়েছিলাম। আমি সব টাকা আমার ছেলের পেছনে খরচ করে দিয়েছি। যেখানে আমার কলিজার টুকরো নেই, আমি সেই টাকা দিয়ে কী করব।’
শরীরের তিন শতাংশ পুড়ে যাওয়া রত্না বেগম চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছেন। তিনি নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলার খামার পাতুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা। কোনো জনপ্রতিনিধি তাদের খোঁজ নিয়েছে কিনা বা সহযোগিতা করেছে কি না, এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘কেউ তাদের খোঁজ নিতে আসেনি। শুধুমাত্র একবার জায়গা পরিদর্শন করতে জেলা প্রশাসকসহ অন্য কর্মকর্তারা এসেছিলেন।’
কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কাউসার আহমেদ বলেন, যারা দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তাদের সেখানেই তাৎক্ষণিক সাড়ে সাত হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। যেসব রোগী মারা গেছেন তাদের প্রত্যেক পরিবারকে উপজেলা প্রশাসন থেকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। ঈদের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর বরাদ্দ থেকে তাদের শাড়ি-লুঙ্গিসহ কিছু ঈদ উপহার দেওয়া হবে।