চাকরি পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাসে এক তরুণীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন জাতীয় পার্টির (জেপি) নেতা সালাম মিয়া ওরফে সালাম বাহাদুর। পাঁচ বছর ধরে চলা সেই সম্পর্কের সূত্রে তিনি প্রায়ই মানিকগঞ্জের সিংগাইরের গাজিন্দা বড়পাড়া গ্রামে ওই তরুণীর বাড়িতে যেতেন। বিষয়টি দেখে ফেলে সিংগাইরের ‘ফিটিং পার্টি’ হিসেবে চিহ্নিত সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যরা। গত শনিবার সালাম ওই বাড়িতে গেলে পার্টির সদস্যরা তাকে আটকে নির্যাতন চালায়। সালামের কাছ থেকে ৭ লাখ টাকার চেকও নেয় তারা। দফায় দফায় নির্যাতনের পর গ্রাম্য চিকিৎসক মোশরাফ হোসেনকে দিয়ে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসাও দেওয়া হয়। পরে সালামের অবস্থার অবনতি হলে তাকে প্রাইভেটকারে ঢাকা আনা হয়। পথে তিনি মারা গেলে তার লাশ ফেলে দেওয়া হয় রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের সড়কে। নিহত সালাম জেপির কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরে। থাকতেন রাজধানীর ধানমন্ডিতে। তিনি সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঠিকাদার ছিলেন। পুলিশ ব্ল্যাকমেইলের শিকার তরুণী ও তার মাকে গ্রেপ্তার করলে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। গতকাল বুধবার তাদের আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ। কালবেলার পক্ষ থেকে গতকাল সিংগাইরের ধরলা ইউনিয়নের গাজিন্দা গ্রামে ওই তরুণীর বাড়িতে গিয়েও সালামকে নির্যাতনে জড়িতদের নাম পরিচয় পাওয়া যায়। ঢাকায় পুলিশের সূত্র বলছে, একসময় ওই তরুণীর পরিবার ঢাকায় থাকত। কিন্তু সালামের কাছ থেকে রক্ষা পেতে তারা গ্রামের বাড়ি সিংগাইর চলে যান। সেখানেও সালাম ওই তরুণীর সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেষ্টায় ছিলেন। বিষয়টি তরুণীর পরিবার ছাড়াও প্রতিবেশীদের মধ্যে জানাজানি হয়। এতে সালামকে নিষেধ করা হলেও তিনি তরুণীর অন্তরঙ্গ সময়ের ভিডিও অনলাইনে ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে অবৈধ সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এতে ক্ষিপ্ত হন তরুণীর মা। পরে তিনি স্থানীয় সন্ত্রাসীদের কাছে বিষয়টি জানিয়ে ‘নিস্তার’ চেয়েছিলেন। ওই তরুণী ও তার মাকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়ে গতকাল সংবাদ সম্মেলন করেন পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের কর্মকর্তারা। সেখানে তেজগাঁও বিভাগের ডিসি এইচ এম আজিমুল হক বলেন, সরকারি চাকরির প্রলোভনে সালাম ও অভিযুক্ত মেয়েটির মধ্যে প্রথমে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। কিছুদিনের মধ্যে মেয়েটি বুঝতে পারেন, সালাম তাকে চাকরির বিষয়ে সহায়তা করতে পারবেন না। বিষয়গুলো জানাজানি হলে এ সম্পর্ক থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন ওই তরুণী। কিন্তু সালাম তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও তরুণীর পরিচিতজনদের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য চাপ দিতে থাকেন। মেয়েটির পরিবার এ নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়ে এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে থাকে। আজিমুল হকের ভাষ্য, ঘটনার দিন বিকেল ৩টার দিকে সালাম মেয়েটির বাসায় যান। এ সময় মেয়ের মা ও সালামের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়। এসব শুনে আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন। তারা মা ও মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে সালামকে বেধড়ক মারধর শুরু করেন। তা ছাড়া ওইদিন সালাম আসবেন, বিষয়টি স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী লোকও জানতেন। তারা ঘটনাস্থলে এসে সালামকে আবারও মারধর করেন। গুরুতর আহত অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখেন। মূলত আহত সালামকে আটকে রেখে আর্থিক সুবিধা আদায় ও বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার উদ্দেশ্য থেকে মা, মেয়েসহ তারা এ ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন। পুলিশের এ কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘক্ষণ রক্তক্ষরণের একপর্যায়ে সালামের
শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। এ সময় অভিযুক্ত কয়েকজন ও মেয়েটির মা আহত সালামকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য বের হন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই সালামের মৃত্যু হয়। বিষয়টি বুঝতে পেরে সালামের ‘প্রেমিকার’ মায়ের সঙ্গে আসা ব্যক্তিরা মাঝপথেই নেমে যান। পরে প্রেমিকার মা সালামকে জরুরি বিভাগের প্রবেশপথে রেখে চলে যান। নির্যাতনে সিংগাইরের ফিটিং পার্টি: গতকাল কালবেলার পক্ষ থেকে সিংগাইরে ওই তরুণীর বাড়ি ও আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বললে সালামের ওপর নির্মম নির্যাতনের বিষয়টি বেরিয়ে আসে। অভিযুক্তরা প্রভাবশালী ও চিহ্নিত সন্ত্রাসী হওয়ায় কেউ মুখও খুলতে চাননি। জনপ্রতিনিধিরাও তাদের বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা জানান। তবে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সালামকে নির্যাতনে নেতৃত্ব দেন গাজিন্দা গ্রামের চিহ্নিত ফিটিং পার্টির সদস্য আকাশ আহমেদ নয়ন, হজরত আলী ওরফে হজা ডাকাত এবং হজার বোন ময়না আক্তার। তাদের সঙ্গে হজরতের ভাই সুলতান, নয়নের ভাই বারেক, হজরতের ছেলে মোসলেম উদ্দিন, সুলতানের ছেলে পিন্টু, স্থানীয় মনির, তার দুই ভাই আনোয়ার ও দেলোয়ার, বাবু মিয়া ও তার ভাই আবুল মিয়া, জসিম ওরফে পাঙ্গা জসিম এবং রফিক। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, সালামকে বেধড়ক পেটানোর পাশাপাশি ড্রিল মেশিন দিয়ে তার পায়ে চলে নির্মম নির্যাতন। তিনি এতে অচেতন হয়ে পড়লে পানি দিয়ে তাকে সুস্থ করা হয়। ফের চলে নির্যাতন। একপর্যায়ে তার অবস্থা গুরুতর হয়ে উঠলে গ্রাম্য চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এভাবে নির্যাতন করে তার কাছ থেকে সাত লাখ টাকার চেক নেওয়া হয়। চেকটি তরুণীর মায়ের নামে নেওয়া হয়। সালাম মারা যাওয়ার পর তরুণীর মা চেকটি আতঙ্কে পুড়িয়ে ফেলেন। প্রতিবেশীদের কয়েকজন জানান, বিকেল থেকেই তরুণীর বাড়ি থেকে চিৎকারের শব্দ আসছিল। তাদের কয়েকজন সেখানে যেতে চাইলেও ময়না আক্তার রামদা দিয়ে তাদের ধাওয়া করেন। একপর্যায়ে আশপাশের এলাকাতেও ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে লোকজন আসতে থাকেন। তখন সন্ত্রাসীরা ওই বাড়ির আশপাশে রামদা নিয়ে অবস্থান নেন। স্থানীয় সূত্র বলছে, চিহ্নিত এই সন্ত্রাসী চক্রটি এলাকায় কেউ নতুন বাড়ি করলেও চাঁদা আদায় করে। বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানেও তাদের চাঁদা দিতে হয়। আগে অনেকে নির্যাতনের শিকার হলেও আতঙ্কে কেউ থানা পুলিশ পর্যন্ত যাননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আকাশ আহমেদ নয়ন সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক। যদিও আগে তিনি বিএনপি করতেন। এ ছাড়া অন্য সদস্যরাও একসময় বিএনপির রাজনীতি করলেও গত কয়েক বছরে সরকার সমর্থক পরিচয় দিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন।
মন্তব্য করুন