‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,/অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত’—চিরবিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। প্রেমে, সাম্যে, অসাম্প্রদায়িকতার গান গেয়ে গেছেন বাংলা ভাষায়। আজ ১১ই জ্যৈষ্ঠ, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী।
নজরুল ছিলেন বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সংগীতকার। মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যিক জীবনে তার সৃষ্টির যে প্রাচুর্য, তা তুলনাহীন। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও নজরুলের প্রধান পরিচয় তিনি কবি।
প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি, সাম্য এবং অসাম্প্রদায়িকতার কবি।
বিংশ শতাব্দীর বাঙালি মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাভাষীদের মধ্যে তার কবিতা ও গানের জনপ্রিয়তা তুঙ্গস্পর্শী। তার মানবিকতা, ঔপনিবেশিক শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে দ্রোহ, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধতা বোধ এবং নারী-পুরুষের সমতার বন্দনা গত একশ বছর ধরে বাঙালির মানস গঠনে ভূমিকা রেখে চলেছে।
তার জীবন শুরু হয়েছিল অকিঞ্চিৎকর পরিবেশে। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। মুসলিম পরিবারের সন্তান এবং শৈশবে ইসলামী শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েও তিনি বড় হয়েছিলেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ সত্তা নিয়ে।
১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে এক বাঙালি মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নজরুল। পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তার শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয় এবং মাত্র ১০ বছর বয়সে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নামতে হয় তাকে। নজরুলের শিক্ষাজীবন নিরবচ্ছিন্ন নয়। এরই মধ্যে তিনি কখনো কবিগানের দলে, কখনো রুটির দোকানে কাজ করেছেন। দোকানে বসেই লিখতেন কবিতা, ছড়া। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে মাধ্যমিকের প্রি-টেস্ট পরীক্ষা না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন।
বলা যায়, নজরুলের সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি এই করাচি সেনানিবাসেই। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধ শেষ হলে সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন নজরুল।
যুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। তার সঙ্গে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদ। এখান থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল।
১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। এ ছাড়া নজরুল তার অতুলনীয় প্রতিভায় বাংলা গানের জগৎকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। তার গানের সংখ্যা চার হাজারের অধিক। গানেও কবির প্রেম, বিদ্রোহ, সাম্য ও সুন্দরের প্রতি আকাঙ্ক্ষাকে চিহ্নিত করা যায়।
তার বিদ্রোহীভাবাপন্নতা ও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সক্রিয়তার জন্য তাকে কারাবরণও করতে হয়েছে। ১৯২২ সালে নজরুলের রাজনৈতিক কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ প্রকাশিত হয়। এই কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার ওই সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একই দিনে তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বাংলা গদ্যসাহিত্যেও নজরুলের অবদান অভূতপূর্ব। ১৯২২ সালে নজরুলের একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়, যার নাম ব্যথার দান। এ ছাড়া উপন্যাস ও প্রবন্ধসাহিত্যে নজরুলের স্বাতন্ত্র্য বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
নবযুগে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নজরুল বেতারে কাজ করছিলেন। এমন সময় অর্থাৎ ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তার অসুস্থতা সম্পর্কে সুস্পষ্টরূপে জানা যায় ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে। ১৯৪২ সালের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। এরপর যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও নজরুলের স্বাস্থ্যের বিশেষ কোনো উন্নতি হয়নি। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে কবির ছোট ছেলে এবং বিখ্যাত গিটারবাদক কাজী অনিরুদ্ধ মৃত্যুবরণ করে। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
জাতীয় কবির জন্মজয়ন্তী ঘিরে প্রতিবারের মতো এবারও সারা দেশে কবির ভক্ত ও বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে নানা রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন রয়েছে। কবির জন্মদিন উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পৃথক বাণী প্রদান করেছেন।