মানিকগঞ্জের সিংগাইরে হত্যা, প্রকাশ্যে কোপানো, অপহরণ, মাদক কারবার, জমি দখল কিংবা প্রতারণা—এমন কোনো অপকর্ম নেই তারা করেন না। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিজেদের পেশা বানিয়েছেন তারা। সবকিছুই করছেন ব্যানারনির্ভর রাজনৈতিক পরিচয়কে ঢাল করে। তারা এলাকায় ‘ফিটিং পার্টি’ নামে পরিচিত। এই চক্রের প্রধান আকাশ আহাম্মেদ নয়ন। যিনি সিংগাইর উপজেলা মোটর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক। এই চক্রে সরাসরি যুক্ত আরও সাত সদস্য রয়েছেন, এজন্য তাদের ‘সেভেন স্টার ফিটিং পার্টি’ নামে চেনেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় সূত্র জানায়, এই অপরাধ চক্র ১০ বছর ধরে মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। তাদের ভয়ে নির্যাতনের শিকার হওয়া লোকজনও মুখ খুলতে সাহস পান না। অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছায়ায় তাদের এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলায় স্থানীয় প্রশাসনও থাকে নিশ্চুপ।
গত বছরের জুলাইয়ে জাতীয় পার্টির (জেপি) কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক আব্দুস সালাম বাহাদুরের মরদেহ মেলে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখতে পায়, তার মরদেহ প্রাইভেটকার থেকে ফেলে দেওয়া হয়। ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে সামনে আসে মানিকগঞ্জের এই ফিটিং পার্টির নাম। ওই হত্যার ঘটনার মূলহোতা ফিটিং পার্টির প্রধান আকাশ আহাম্মেদ নয়ন বলেও বেরিয়ে আসে পুলিশের
তদন্তে।
স্থানীয় সূত্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, নয়ন সিংগাইর উপজেলা মোটর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক। মূল দলের অনুমোদনহীন ও সাইনবোর্ডসর্বস্ব ওই সংগঠনের রাজনীতির এবং পদ ব্যবহার করেই তিনি গ্রুপ গঠন করে অপকর্ম করে চলেছেন। সিংগাইরে নয়ন গ্রুপের হজ মিয়া ডাকাত, মো. সুলতান, মো. শরিফ, মো. জসিম, মো. রুবেল, মো. পিন্টু, মো. বারেক—এই সাতজন এলাকাবাসীর কাছে আতঙ্কের নাম। এর বাইরে প্রয়োজনে এলাকার কিশোর গ্যাংসহ নানা অপরাধীকে ব্যবহার করেন নয়ন।
সিংগাইরের বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হজ মিয়া একসময় দুর্ধর্ষ ডাকাত ছিলেন। দেশের বিভিন্ন এলাকায় দলবল নিয়ে ডাকাতি করতেন। পরে নয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এলাকায় তাণ্ডব চালানো শুরু করেন। তাদের সবার বাড়ি সিংগাইর উপজেলার ধল্লা ইউনিয়নের গাজীন্দা গ্রামে। এই অঞ্চলে তারা নিজেদের অপরাধ রাজ্য গড়ে তুলেছেন। তাদের কথার বাইরে গেলেই এলাকাবাসীর ওপরে নেমে আসে নির্যাতনের খড়্গ।
গাজীন্দা গ্রামের অন্তত আট বাসিন্দা কালবেলাকে বলেছেন, আকাশ আহম্মেদ নয়ন এলাকায় গড়ে তুলেছেন সন্ত্রাসী বাহিনী। এর আগে সাবেক এমপি মমতাজ বেগমের পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে মমতাজের পক্ষ হয়ে তার স্বামী ডা. মঈন আহম্মেদকে মারধর ও গাড়ি ভাঙচুর করে নয়নের সহযোগীরা। এর পরই এই নয়নের নামডাক ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। লোকজনও তাকে ভয় পেতে শুরু করে। ওই ঘটনায় মঈন থানায় অভিযোগ করেও প্রতিকার পাননি। এ ছাড়া নয়নের ধারাবাহিক নির্যাতনের শিকার হয়ে দীর্ঘদিন বাড়িছাড়া ছিল প্রতিবেশী জাহিদুল ইসলাম ছাহিমের পরিবার।
জানতে চাইলে ডা. মঈন আহম্মেদ কালবেলাকে বলেন, ‘পারিবারিক একটা ইস্যু নিয়ে নয়ন আমার ওপর হামলা চালায়। কিন্তু আমি কোথাও এর বিচার পাইনি। এরপর আমি আর বিষয়টি নিয়ে আগাইনি।’
গ্রামের এক বাসিন্দা জানান, এই নয়ন গ্রুপ তুচ্ছ কারণে তার ভাইকে এলোপাতাড়ি কুপিয়েছে। তার বাড়িঘর ভেঙে ফেলেছে। তাদের অত্যাচারে অনেকদিন পর্যন্ত এলাকায় প্রবেশ করতে পারেননি তারা।
নয়ন গ্রুপের ভয়াবহতা বোঝাতে নির্যাতনের শিকার ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আমরা আর কী, এই নয়ন ও হজ মিয়াকে তো স্থানীয় চেয়ারম্যান জাহিদ ভূঁইয়া পর্যন্ত ভয় পান।’
সরেজমিন নয়নের এলাকায় গিয়ে কথা হয় আরও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। তবে নয়নের নাম শুনতেই তাদের চোখে-মুখে চলে আসে আতঙ্ক। তারা অনেক তথ্য দেন। তারা বলেছেন, এই ফিটিং পার্টির মূল প্রশ্রয়দাতা সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহীদুর রহমান শহীদ। শহীদ মানিকগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের সাবেক স্বামী রশীদ বয়াতির ভাগনে। যদিও অনেকেই তাকে জানেন জনপ্রিয় শিল্পী মমতাজ বেগমের আপন ভাগনে তিনি।
এলাকাবাসীর অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় শহীদুর রহমান শহীদের সঙ্গে। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে ভালো-খারাপ সব ধরনের মানুষের সঙ্গেই আমাদের পরিচয় থাকে। কেউ কোনো অপরাধ করে থাকলে সেটি তার ব্যক্তিগত বিষয়। আইন অনুযায়ী সবার বিচার হবে।’ তিনি বলেন, ‘ফিটিং পার্টিকে আমি প্রশ্রয় দিই বা আমার ক্ষমতা নিয়ে তারা চলে, বিষয়টি মিথ্যা এবং অপপ্রচার।’
যেভাবে উঠে আসে ফিটিং পার্টির নাম: গত বছরের ১৬ জুলাই রাত ১১টায় একটি গাড়ি থেকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে একটি লাশ ফেলে দেওয়া হয়। রাজধানীর এমন ব্যস্ততম সড়কে এভাবে প্রকাশ্যে লাশ ফেলে দেওয়ার ঘটনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পরে জানা যায়, লাশটি জেপির কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক আব্দুস সালাম বাহাদুরের। এ ঘটনায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা হয়। পরে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে মানিকগঞ্জে হত্যা করে লাশটি এনে রাজধানীতে ফেলে দেওয়া হয়। আর এই হত্যায় সরাসরি জড়িত ফিটিং পার্টির নয়ন, হজ মিয়া ডাকাত, হজ মিয়ার বোন ময়না আক্তার, ভাই সুলতান, নয়নের ভাই বারেক, হজের ছেলে মোসলেম উদ্দিন, সুলতানের ছেলে পিন্টু, স্থানীয় মনির, তার দুই ভাই আনোয়ার ও দেলোয়ার, বাবু মিয়া ও তার ভাই আবুল মিয়া, জসিম ওরফে পাঙ্গা জসিম এবং রফিক।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সিংগাইরের এক তরুণীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক ছিল সালামের। ওই তরুণী একসময়ে তার মায়ের সঙ্গে ঢাকায় থাকতেন। পরে ওই মেয়েকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে তার সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান সালাম। একসময় ওই সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসার জন্য ঢাকা ছেড়ে সিংগাইরে গ্রামের বাড়ি চলে যান মা-মেয়ে। কিন্তু সালাম তাদের পিছু ছাড়েননি। তিনি প্রায়ই সিংগাইরের গাজীন্দা বড়পাড়া গ্রামে ওই তরুণীর বাড়িতে যেতেন। বিষয়টি চোখে পড়ে ফিটিং পার্টির সদস্যদের। তারা পরিকল্পনা করেন যে, সালামকে ফাঁদে ফেলে তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করবেন। সালামের হাত থেকে নিস্তার পেতে মা-মেয়েও এই পরিকল্পনায় যুক্ত হন। গত বছরের ১৬ জুলাই সালাম ওই বাড়িতে গেলে নয়ন পার্টির সদস্যরা জেপি নেতাকে আটকে নির্যাতন করে ৭ লাখ টাকার চেকও নেন। দফায় দফায় নির্যাতনের পর গ্রাম্য চিকিৎসক মোশরাফ হোসেনকে দিয়ে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসাও দেওয়া হয়। পরে সালামের অবস্থার অবনতি হলে তাকে প্রাইভেটকারে ঢাকা আনা হয়। পথে তিনি মারা গেলে তার লাশ ফেলে দেওয়া হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের সড়কে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন এই ফিটিং পার্টির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয় না। গাজীন্দা গ্রামকে একটা অপরাধের দুর্গ বানিয়ে রেখেছে এই ফিটিং পার্টি। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের প্রশ্রয় তো আছেই।
তবে ভয়ংকর এই ফিটিং পার্টির বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানালেন সিংগাইর থানার ওসি মো. জিয়ারুল ইসলাম। ‘আমি দায়িত্ব নিয়েছি বেশিদিন হয়নি’ বলে এড়িয়ে যান তিনি।
অবশ্য মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিএমপির এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, এ ঘটনায় নয়ন ছাড়া মামলার সব আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তারা বর্তমানে জামিনে আছে। বিভিন্ন সময় নয়নকে গ্রেপ্তারে তার এলাকায় অভিযান চালানো হলেও তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। কারণ অভিযানের আগেই কোনো না কোনোভাবে সে জেনে যায়। আর স্থানীয় কেউই তার বিরুদ্ধে কথা বলতে চান না। নয়ন যাদের নির্যাতন করেছে, জমি দখল করেছে, তারাও নয়নের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পান।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার রুবাইয়াত জামান কালবেলাকে বলেন, জেপি নেতা সালাম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি চাঞ্চল্যকর। মামলাটি আমরা অনেকদিন ধরে তদন্ত করছি। সব আসামিকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তবে কয়েকজনকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি। তাদের গ্রেপ্তারে আমাদের অভিযান অব্যাহত। দ্রুত মামলাটির চার্জশিট দেওয়া হবে।