কোটা সংস্কার আন্দোলনের দাবিকে কেন্দ্র করে রূপ নেওয়া ছাত্র-জনতার চূড়ান্ত অভ্যুত্থানের ফলে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় ১৬ বছরের শাসনের অবসান হয়েছে। এ আন্দোলন পরিচালনায় প্রথম থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার। সম্প্রতি তিনি আন্দোলন, অন্তর্বর্তী সরকার, ছাত্ররাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কালবেলার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মো. জাফর আলী
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক হিসেবে নতুন বাংলাদেশ পাওয়ার অনুভূতি কী?
আবু বাকের মজুমদার: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রথমে কোটা বৈষম্য নিয়ে শুরু করে। আন্দোলন চলাকালে আমাদের ভাইদের শহীদ করার পরিপ্রেক্ষিতে নয় দফা থেকে আমরা এক দফায় যাই এবং এক দফা সফল হয়। সেই আন্দোলনের আমি একজন সংগঠক হিসেবে ছিলাম। তার আগে থেকেই আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। তখন তৎকালীন সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ আমাদের নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে। দেশে চলমান সেই ফ্যাসিবাদী সিস্টেমের প্রতি সবসময় ঘৃণা পোষণ করতাম। সবসময় আসলে এ চিন্তাই করতাম যে, এই ফ্যাসিবাদী সিস্টেম কীভাবে বিলুপ্ত করা যায়, স্বৈরাচারকে কীভাবে হঠানো যায়। ৫ আগস্ট সেটা যখন বাস্তবায়িত হয় এবং নতুন বাংলাদেশ পেয়ে যাই, তখন কিছুটা উদ্দীপনা কাজ করাটা স্বাভাবিক। এখন আমরা আমাদের দেশকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনাগুলো নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখছি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্ল্যাটফর্মটি বর্তমানে কতটুকু কাজ করতে পারছে বলে মনে করেন? আর বর্তমানে এর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বজায় আছে কি না?
আবু বাকের মজুমদার: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আমরা জাতির কাছে দুটি অঙ্গীকার করে বলেছিলাম, আমরা এই ফ্যাসিবাদী সিস্টেমের সম্পূর্ণ বিলোপ আমরা করতে চাই এবং বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করতে চাই। সেই অঙ্গীকার নিয়েই এই প্ল্যাটফর্ম কাজ করে যাচ্ছে এবং তা অটুট রয়েছে। এটা যেহেতু একটি গণআন্দোলন ছিল এবং ছাত্ররা এতে নেতৃত্ব দিয়েছিল। তখন সর্বস্তরের লোকজনকে সুসংগঠিত করা অনেক কঠিন কাজ ছিল। সেই ধারাবাহিকতায় এখনো সুসংগঠিত হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা মনে করছি, আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব এবং জনগণ আমাদের সঙ্গে আছেন। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিভিন্ন মতাদর্শের লোকজন আছেন। সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে এই প্ল্যাটফর্মটি সফল হয়েছে। এর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা এখন পর্যন্ত আশানুরূপ অবস্থায় আছে। এটাকে আরও শক্তিশালী করার জন্য আমরা বিভিন্ন চিন্তাভাবনা করছি এবং এ বিষয়গুলো আলোচনাধীন।
আপনাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অপপ্রচারের অভিযোগ ওঠে বা অপপ্রচার করতে দেখা যায়, এ বিষয়টি কীভাবে দেখেন? অপপ্রচার প্রতিরোধে আপনাদের ভূমিকা কী থাকতে পারে?
আবু বাকের মজুমদার: আমাদের বিরুদ্ধে আসলে অনেক অপপ্রচার হয়েছে বা এখনো হচ্ছে। কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী নিজেদের অবৈধ স্বার্থ হাসিলের জন্য অপপ্রচার করেই যাচ্ছে। আমরা আমাদের জায়গা থেকে এটি প্রতিরোধে কাজ করেছি। আমি মনে করি, আরও সুসংহতভাবে সবাই মিলে এ অপপ্রচার ঠেকানো উচিত। এ ব্যাপারে আমাদের কাজ এবং আলোচনা চলছে। আমরা এমন একটা পদ্ধতি বের করব, যা দিয়ে অপপ্রচার প্রতিরোধ করা যাবে এবং একই সঙ্গে আমাদের কাজের পরিধিকে মানুষের কাছে খুব সুশৃঙ্খলভাবে তুলে ধরতে পারব।
বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার (অন্তর্বর্তী) যেভাবে দেশ পরিচালনা করছে, এতে আপনার কাছে তাদের সফলতা ও ব্যর্থতা কোথায়?
আবু বাকের মজুমদার: ৫ আগস্টের পর গঠিত এই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সর্বস্তরের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি ছিল। কিন্তু সামগ্রিকভাবে জনগণের সেই আশা পূরণে কিছুটা হলেও ব্যর্থ হচ্ছে। যারা সরকারে দায়িত্বপ্রাপ্ত রয়েছে, তাদের কথা শুনে বোঝা যায়, আগের সিস্টেমটা এতই দূষিত যে, তা পরিশুদ্ধ করতে তারা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। কিছু বিষয় সরাসরি জনজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যেগুলোতে সরকারের নজর দেওয়া প্রয়োজন। যেমন—দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিরসন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, মব জাস্টিস নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্য খাত ও অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনয়ন প্রভৃতি। এগুলোতে তারা পিছিয়ে আছেন, এটা তাদের ব্যর্থতার জায়গা। বিশেষ করে, স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা একটু বেশি খারাপ। আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিতে আমরা তাদের আশানুরূপ সাড়া পাইনি। এ বিষয়ে সরকারের আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত ছিল বলে আমি মনে করি। তবে একটি বিষয় না বললেই নয় যে, সব সেক্টরেই ফ্যাসিবাদের কালো থাবা পড়েছিল। সেই সিস্টেমের প্রতিফলনটা এখনো রয়ে গেছে। এজন্য সময় লাগাটা কিছুটা স্বাভাবিক। তারপরও সুচিন্তক, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক লোকের পরিমাণ বাড়িয়ে সৃজনশীল ও গবেষণামূলক কাজের মাধ্যমে সফলতা অর্জন সম্ভব।
ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ বা এর অঙ্গ সংগঠনগুলোর রাজনীতি প্রসঙ্গে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
আবু বাকের মজুমদার: জুলাই-আগস্টে যে গণহত্যা হয়েছে সেই গণহত্যায় আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠনসহ সব দোসর নেতৃত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশে কখনোই তাদের রাজনীতিতে জায়গা পাওয়া উচিত নয় বলে মনে করি। জার্মানির নাৎসি বাহিনীকেও গণহত্যার পর রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। আমরা যে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলছি, সেই বন্দোবস্তে সব রাজনৈতিক অংশীজনের মতামতসহ বাংলাদেশের জনগণের মতামত অনুযায়ী সমাধান চাই। আমরা সব রাজনৈতিক সংগঠন ও জনগণের প্রতি এ আহ্বান জানাই, তারা যেন দেশ এবং জাতির স্বার্থে কল্যাণমূলক এক সিদ্ধান্তে একমত হয়। তারা যেন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করাকে স্পেস না দেয়। যদিও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এটা একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমার দাবি ছিল। আওয়ামী লীগ এবং এর অন্যান্য অঙ্গ সংগঠন গণহত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছে সেগুলোকেও নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। তবে এ ক্ষেত্রে আমার পরামর্শ থাকবে, সব রাজনৈতিক অংশীজনের মতামত যেন নেওয়া হয়। এর আগে আওয়ামী লীগের সময়ে সাজানো নির্বাচনগুলোতে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ফ্যাসিবাদের এনাবলারের ভূমিকা পালন করেছে। এরকম এনাবলার যারা আছে এবং দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ফ্যাসিবাদের সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করার কাজে সহযোগিতা করেছে তাদেরও শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা উচিত। আওয়ামী লীগের সময়ের অবৈধ নির্বাচনগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অবৈধ ঘোষণা করে সেসব নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের সর্বাত্মক শাস্তির আওতায় আনা উচিত।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
আবু বাকের মজুমদার: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আমরা যখন ৯ দফা ঘোষণা করি তখন ছাত্ররাজনীতি নিয়ে আমাদের একটা স্পষ্ট অবস্থান ছিল। তখন আমাদের দাবি ছিল যে, দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস চাই। কারণ, আমরা দেখেছি বিগত সময়ে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে দখলদারিত্বের রাজনীতির চর্চা হতো। এই পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক এবং ভয় কাজ করে এখনো। আমাদের ৯ দফায় যে দাবি ছিল ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সেই দাবিতে অটল রয়েছি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সবসময় দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির বিপক্ষে।
আন্দোলনে অবদান রাখার ক্ষেত্রে ক্রেডিট নেওয়ার বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
আবু বাকের মজুমদার: আন্দোলন চলাকালে আমরা যারা সামনের সারিতে ছিলাম তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী সমর্থন দিয়ে গেছে এবং সহযোগিতা করেছে। এ আন্দোলনে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। এখানে সর্বস্তরের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কারণেই আমাদের এ গণঅভ্যুত্থান সফল হয়েছে। এ সফলতার ক্রেডিট আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, যারা আহত হয়েছেন এবং যারা অংশগ্রহণ করেছেন তাদের সবার। তবে যাকে (প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আব্দুল্লাহ) আন্দোলনের মাস্টার মাইন্ড বলা হচ্ছে, তাকে কখনো মাস্টারমাইন্ড দাবি করতে দেখিনি। তবে এটা সত্য, আমরা যারা সামনের সারিতে ছিলাম তারা জানি যে, আন্দোলনে উনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আমাদের পরামর্শ প্রদান থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে যথেষ্ট পরিমাণে ভূমিকা তিনি রেখেছেন, এটা সত্য।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোনো রাজনৈতিক দল আসবে কি না?
আবু বাকের মজুমদার: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সারা দেশের মানুষের পক্ষ থেকে একটি আশা-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে একটি রাজনৈতিক দল খোলার ব্যাপারে একটা চাপ রয়েছে। তবে এটা নিয়ে আমরা এখনই ভাবছি না। এই মুহূর্তে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যে দুটি অঙ্গীকার ছিল, সেগুলো নিয়েই আমরা চিন্তাভাবনা করছি। তবে এখান থেকে কেউ যদি সামষ্টিক উদ্যোগ নিয়ে রাজনৈতিক দলের দিকে এগোতে চায়, তাহলে সেই উদ্যোগকে আমি সাধুবাদ জানাব। কারণ, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমি রাজনীতিকে বিশ্বাস করি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম আকারে বা এর ব্যানারে কোনো রাজনৈতিক দল আসবে না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত করছি।
কালবেলা পরিবার ও এর পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশে কিছু বলবেন?
আবু বাকের মজুমদার: কালবেলা সবসময় বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রেখে এগিয়ে চলার চেষ্টা করেছে এবং কালবেলা অনলাইন যথেষ্ট পরিমাণে অ্যাকটিভ রয়েছে। কালবেলার ছাপা পত্রিকা বা হার্ডকপি সত্য সংবাদের সংগ্রহ নিয়ে সারা দেশের জনগণের কাছে পৌঁছে এবং বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সরবরাহ করে। আমি আশা করব, সবসময় এ ধারাবাহিকতা যেন বজায় থাকে। কালবেলার জন্য শুভকামনা।