২০২৪ সাল বিভিন্ন কারণেই সবার মনের মধ্যে গেঁথে থাকবে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি থাকবে জুলাই ও আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের কারণে। যেটিকে আন্দোলনকারীরা শিক্ষার্থী-জনতা নাম দিয়েছেন ‘জুলাই বিপ্লব’। ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে দেশছেড়ে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। দলটির টানা সাড়ে ১৫ বছরেরও বেশি সময়ের শাসনের অবসান হয়। রচিত হয় নতুন ইতিহাস।
জুলাই মাসের প্রথমার্ধে অবস্থান, বাংলা ব্লকেড সহ বিভিন্ন অভিনব কর্মসূচির মাধ্যমে স্বতস্ফূর্ত আন্দোলন চলতে থাকে শিক্ষার্থীদের। তবে ১৪ জুলাই চীন সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বলে অভিহিত করলে সেদিন রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ শুরু হয়। পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় সরকার সমর্থকরা।
এরপর আন্দোলন সংঘাতে রূপ নেয়। আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সরকার সমর্থকরা। ১৬ জুলাই রংপুরে আন্দোলনকারী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এই মৃত্যু বারুদের মতো কাজ করেছে। শত বাধার সামনে শক্ত ভীতের মতো দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি জুগিয়েছে। ফলশ্রুতিতে ওইদিন রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের বের করে দিয়ে তাদের কক্ষ ভাঙচুর করে আন্দোলনকারীরা। একে একে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দখলে চলে আসে। এরপর আসে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বন্ধের ঘোষণা। এটি সরকারের প্রতি শিক্ষার্থীদের ক্ষোভকে আরও উসকে দেয় এবং আন্দোলনকে আরও বেগবান করে।
১৭ ও ১৮ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। ১৯ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণা করে। ৯ দফা দাবি না মানা পর্যন্ত এই ‘শাটডাউন’ চালিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। আন্দোলনে এগিয়ে আসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও। এরপর আসে ‘সরকারি কারফিউ’ । বন্ধ করে দেওয়া হয় মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা। তারপরও জুলাইজুড়ে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’, ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’ সহ বিভিন্ন কর্মসূচি চালাতে থাকে আন্দোলনকারীরা। অনেকে হতাহতও হয়। ফেসবুকে চলে লাল আর কালো প্রোফাইল পিকচারের যুদ্ধ।
আগস্টের প্রথম দিন থেকেই এই আন্দোলন আরও বেশি সহিংস হয়ে ওঠে। যার ফলশ্রুতিতে চূড়ান্ত আন্দোলনের ডাক আসে। ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ৪ আগস্ট ঢাকায় লং-মার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ৬ আগস্টের পরিবর্তে এই লংমার্চ একদিন এগিয়ে আনা হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় ঢুকতে শুরু করে আন্দোলনকারীরা। ৫ আগস্ট সকালেও রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ছাত্র-জনতার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ চলে। গুলিতে সেদিনও অনেক শিক্ষার্থী নিহত হন। তবে দুপুর ১২টার দিকে সংবাদ মাধ্যমে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশে ভাষণের ঘোষণা দেন। তখনই রাজধানীর বুকে ছাত্র-জনতার ঢল নামে। ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নেয়া লাখো মানুষের সমাবেশ বেলা আড়াইটার দিকে যাত্রা করে গণভবনের দিকে। এরপর জনগণের উদ্দেশে দেয়া ভাষণে শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং অন্তবর্তী সরকার গঠনের কথা বলেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এতেই আওয়ামী শাসনের অবসান হয়।