কালবেলা: এখন পর্যন্ত সিএমএসএমই খাতে ব্র্যাক ব্যাংক কী কী সাফল্য অর্জন করেছে?
সৈয়দ আব্দুল মোমেন: ২০০১ সালে যাত্রা শুরু করার পর থেকে ব্র্যাক ব্যাংক ক্ষুদ্র ব্যবসা, বিশেষ করে মফস্বল ও গ্রামীণ এলাকায় সহজে ঋণ পাওয়া নিশ্চিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। আমাদের দূরদর্শী প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ ব্যাংকিং সেবার আওতায় বাইরে থাকা 'মিসিং মিডল'দের কাছে এই সেবা নিয়ে যাওয়ার জন্য এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
ব্র্যাক ব্যাংক এখন কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে (সিএমএসএমই) বাংলাদেশের বৃহত্তম জামানত-মুক্ত অর্থায়নকারী, যার ৮৫ শতাংশেরও বেশি ঋণ কোনো জামানতবিহীন। ২০০১ সালে যাত্রা শুরুর পর আমরা ২০ লাখ সিএমএসএমই গ্রাহককে ২ লাখ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছি। আমরা তৃণমূল পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের পরিপূর্ণ ব্যাংকিং ও আর্থিক অংশীদার হতে চাই।
গতানুগতিক ব্যাংকিংয়ের বাইরে গিয়ে আমরা আমাদের সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের সেবা দিয়ে থাকি। আমরা তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, নেটওয়ার্কিং ও বাজারে প্রবেশের সুবিধা দেওয়াসহ অনেক ধরনের সহায়তা প্রদান করি। আমাদের দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি যেমন ‘উদ্যোক্তা ১০১’ এবং ‘আমরাই তারা’ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের উদ্যোক্তা হিসেবে সাফল্য পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা এনে দেয়। আমরা আমাদের উদ্ভাবনী ডিজিটাল লোন প্রোডাক্ট যেমন ‘সাফল্য’ ও ‘জীবিকা’ এবং রেমিট্যান্স প্রবাহকে উৎসাহিত করতে ‘স্বাবলম্বী-রেমিট্যান্স প্রাপকের জন্য ঋণ সুবিধা’-এর মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা সেগমেন্টে পৌঁছে যাচ্ছি।
সব সিএসএসএমই উদ্যোক্তাকে আনুষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থার আওতায় আনতে আমাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। আমাদের আরও আগে যদি বর্তমানের মতো ‘আস্থা’ ইন্টারনেট ব্যাংকিং অ্যাপ, ই-ল্যাপঃ স্বয়ংক্রিয় লোন অরিজিনেশন সিস্টেম, ডিজিটাল লোন ‘সাফল্য’, ‘জীবিকা’ প্রভৃতির মতো ডিজিটাল অবকাঠামো থাকত, তাহলে আমরা অনেক আগেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আরও বেশি উদ্যোক্তার কাছে পৌঁছাতে পারতাম। সিএসএসএমই প্রতিষ্ঠানগুলো ডিজিটাল সলিউশনসের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা দ্রুত, সাশ্রয়ীভাবে এবং আরও সহজভাবে পায়। এ ছাড়াও এসএমই খাতের উন্নয়নকে আরও ত্বরান্বিত, আধুনিকায়ন এবং উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য দেশের সর্বপ্রথম ব্যাংক হিসেবে, সম্প্রতি ‘এসএমই ইনোভেশন ল্যাব’ চালু করেছে ব্র্যাক ব্যাংক, যার ফলে উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন নতুন উদ্ভাবনী সেবা চালু করা সম্ভব হবে।
কালবেলা: আগামী পাঁচ বছরে ব্র্যাক ব্যাংকের এসএমই ব্যবসা কোথায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন? আপনি এ নিয়ে কতটা আত্মবিশ্বাসী?
সৈয়দ আব্দুল মোমেন: বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে ইমপ্যাক্টফুল ব্যাংক হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশে এসএমই ব্যাংকিংয়ের প্রবর্তক ব্র্যাক ব্যাংক। আর এই দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংকে পরিণত হওয়ার কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে এসএমই ব্যাংকিং। কেননা ব্র্যাক ব্যাংকের অ্যাসেট বুকের প্রায় ৪২ শতাংশ হচ্ছে এসএমই।
ব্র্যাক ব্যাংক তৃণমূল পর্যায়ের সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের সহজে অর্থায়নের সুযোগ দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের এসএমই ঋণ পোর্টফোলিও ৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং এসএমই আমানতের পোর্টফোলিও ১৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় যথাক্রমে ১৬ শতাংশ ও ৫৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি অর্জিত হয়েছে দেশের চ্যালেঞ্জিং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে। এটি আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রবৃদ্ধির কৌশলের একটি নিদর্শন। বর্তমানে দেশে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মোট এসএমই অর্থায়নের ১৬ দশমিক ৭ শতাংশই আমাদের, যা আগামী পাঁচ বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।
কালবেলা: ব্যাংকগুলো ডিজিটাল দিক থেকে অনেক অগ্রসর হয়েছে; কিন্তু এসএমই খাত এ দিক থেকে পিছিয়ে। এসএমই ডিজিটাইজেশন সম্পর্কে আপনাদের পরিকল্পনা কী?
সৈয়দ আব্দুল মোমেন: এসএমই ব্যাংকিংয়ের বিকাশের জন্য প্রযুক্তি ঢেলে সাজানো অত্যাবশ্যক। আমাদের উপাত্ত থেকেও দেখা যাচ্ছে যে, প্রযুক্তি গ্রাহকদের পথচলা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করে, প্রক্রিয়াগুলো ত্বরান্বিত করে এবং সুবিধাগুলো বাড়ায়। তাই আমাদের ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ নিরলসভাবে তা বাস্তবায়ন করছে এবং এসএমই ব্যাংকিংয়ের ডিজিটাইজেশনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
ব্র্যাক ব্যাংক এসএমই লোন অরিজিনেশন সিস্টেমের (ই-ল্যাপ) মাধ্যমে দেশব্যাপী ডিজিটাল এসএমই ঋণ প্রক্রিয়াকরণ চালু করেছে। এটি ঋণের আবেদন প্রক্রিয়াকে সহজ করেছে, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি নিশ্চিত করেছে এবং ঋণ প্রক্রিয়াকরণের সময় কমিয়ে দিয়েছে। দেশের প্রান্তিক অঞ্চলে অর্থায়নের সুবিধা পাওয়া সহজ করার জন্য ব্র্যাক ব্যাংক দেশের প্রথম ডকুমেন্ট-লেস রিয়েল-টাইম ডিজিটাল এসএমই ঋণ ‘সাফল্য’ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যক্তিক ডিজিটাল ঋণ ‘জীবিকা’ চালু করেছে। ফলে ব্যাংক দেশব্যাপী অতি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছে আধুনিক ব্যাংকিং সেবা নিয়ে যেতে পেরেছে, যা আগে সম্ভব ছিল না।
ব্র্যাক ব্যাংক বিদ্যমান প্রক্রিয়া ও প্রোডাক্টের একটি সামগ্রিক প্রযুক্তিচালিত রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করবে, যা দ্রুত প্রক্রিয়াকরণের সুযোগ করে দেবে এবং সেবার খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করবে।
সারা বাংলাদেশে সিএমএসএমই খাতের মধ্যে বৈচিত্র্যময় সেগমেন্টগুলোতে ব্যাপক ব্যাংকিং সেবা প্রদানের জন্য ডিজিটাল সুবিধার মাধ্যমে এসএমই ব্যবসা রূপান্তর করাই এর লক্ষ্য। ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে প্রোডাক্ট এবং প্রক্রিয়ার রূপান্তর, গ্রাহককেন্দ্রিক ও উদ্ভাবনী প্রোডাক্ট এবং প্রচলিত সীমানা ছাড়িয়ে সুযোগ অন্বেষণ আগামীতে এসএমই খাতে ক্রমবর্ধমান ব্যবসার চাবিকাঠি হবে।
মন্তব্য করুন