কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ৩০ জুলাই ২০২৫, ০৭:৩৫ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ঘরে ঘরে বিশ্বস্ত বন্ধু ওরস্যালাইন

ঘরে ঘরে বিশ্বস্ত বন্ধু ওরস্যালাইন

ওরস্যালাইন ১৯ শতকের অভাবনীয় উদ্ভাবন

তসলিম উদ্দিন খান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এসএমসি

গোলটেবিল বৈঠকে সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানির (এসএমসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তসলিম উদ্দিন খান মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, ওরস্যালাইন আইসিডিডিআর,বির একটি মহান উদ্ভাবন। পরবর্তী সময়ে ব্র্যাক নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে এর জনপ্রিয়তা বাড়াতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। পাবলিক হেলথের বাইবেলখ্যাত ল্যানসেট পত্রিকা ১৯৭৮ সালে উল্লেখ করেছে, ‘ওরাল ডিহাইড্রেশন সলিউশন ইজ দ্য মোস্ট ইম্পরট্যান্ট মেডিকেল অ্যাডভান্স অব দ্য টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফও ওরস্যালাইনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সারা বিশ্বের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ওরস্যালাইন আবিষ্কার ২০ শতকের একটি উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন। তসলিম উদ্দিন খান বলেন, ডায়রিয়াসহ অন্যান্য পানিশূন্যতা প্রতিরোধের মাধ্যমে ওরস্যালাইন কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করেছে, বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সী ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুদের। এসএমসি ১৯৮৫ সালে প্যাকেটজাত ওআরএসের বাজারজাত শুরু করে। তখন আমাদের লক্ষ্য ছিল, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুর মৃত্যুহার কমানো। ১৯৯৮ সালে বিপণন ব্যবস্থায় এক বিরাট পরিবর্তন আসে। বাংলাদেশ সরকার ফার্মেসি আউটলেটের পাশাপাশি নন-ফার্মেসি আউটলেটে ওআরএস সরবরাহের অনুমতি দেয়। ফলে ওআরএস সহজলভ্য হয়ে যায়। এই ৪০ বছরের প্রতিশ্রুতিশীল পথচলায় বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৫৫ থেকে বেড়ে ৭২.৩ বছর হয়েছে এবং শিশুর মৃত্যুহার প্রায় ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। ২০০৪ সাল থেকে আমরা নিজস্ব বিশ্বমানের ফ্যাক্টরিতে ওরস্যালাইন-এন উৎপাদন শুরু করি, যা বাজারের চাহিদা পূরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরামের জরিপে সারা দেশে চতুর্থ জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের স্বীকৃতি অর্জন করে এসএমসি ওরস্যালাইন। তিনি আরও বলেন, দেশের ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ ওরস্যালাইন খাচ্ছে। বাকি ২৫ শতাংশ শিশুকেও এর আওতায় আনা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে দুর্গম এলাকা, জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল ও অতিদরিদ্র পরিবারের সন্তানদের ওরস্যালাইনের আওতায় আনতে হবে। এজন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী ও মিডিয়ার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।

বন্যায় ভালো ভূমিকা রাখে

অধ্যাপক ডা. মো. রিজওয়ানুর রহমান অতিরিক্ত মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

বন্যার সময় ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ে, এই সময় ওরস্যালাইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় থেকে আমরা যথাযথভাবেই ওরস্যালাইন সরবরাহ করে থাকি। ফলে কোনো পানিশূন্যতাজনিত ক্ষতি হয় না। রক্তে যে পরিমাণ সোডিয়াম, পটাশিয়াম থাকার কথা, সেটা কমে গেলে ঠিক করা জরুরি হয়ে পড়ে। খুব বেশি কমে গেলে তখন রোগীর বড় ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দেয়। পানিশূন্যতার কারণে প্রায়ই কিডনির সমস্যা চোখে পড়ে। এসব ছোট ছোট সমস্যা আমরা ওআরএস দিয়ে সমাধান করতে পারি। এই ওআরএস যে পরিমাণ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আগে মানুষের কত ডায়রিয়া হতো, কলেরা হতো—ওরস্যালাইন আবিষ্কার হওয়ার পর তা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ওরস্যালাইন সরবরাহ নিশ্চিত এবং যথাযথ ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ নিশ্চিত করা। যদি প্রয়োজন না হয় তবে যেন আমরা ওআরএস না খাই। কারণ অপ্রয়োজনে ওআরএস পান করা আরেকটা ক্ষতির কারণ।

পাবলিক হেলথ ক্লাব করতে হবে

অধ্যাপক ড. ফরিদ এ. সোবহানী,উপাচার্য ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি

ওরস্যালাইন উদ্ভাবন, তৈরি ও সচেতনতার জন্য আমরা আইসিডিডিআর,বি, এসএমসি এবং ব্র্যাকের কাছে কৃতজ্ঞ। আমরা বাপ-দাদার কাছে শুনেছি কলেরা মহামারির কথা। ওই সময়ে হাজার হাজার মানুষ মারা যেত কলেরায়। বাংলাদেশ গার্মেন্টস খাত বিশ্ববাসীকে বিভিন্ন ধরনের বস্ত্র উপহার দিচ্ছে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতের শ্রেষ্ঠ উপহার ওরস্যালাইনের আবিষ্কার। আইসিডিডিআর,বির কল্যাণে বিশ্ববাসী ডায়রিয়া প্রতিরোধে ওরস্যালাইন বিরাট ভূমিকা রাখছে। আমার ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে ২৫টি ক্লাব রয়েছে। সেখানে আমরা আরও একটি নতুন ক্লাব চালু করেছি। যেটা পাবলিক হেলথ ক্লাব। দেশে এখন ১১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যদি সবাইকে একটি চিঠি দিয়ে বলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক হেলথ ক্লাব করতে হবে। তাহলে এই কাজ আরও ত্বরান্বিত হবে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা থাকলে নিয়ম মেনে যথাযথ ডোজে স্যালাইন খেলে সুস্থতা ও মৃত্যুহার কমে যাবে।

দেশে ১ শতাংশ শিশুর ডায়রিয়ায় মৃত্যু

ডা. তাহমিদ আহমেদ,নির্বাহী পরিচালক, আইসিডিডিআর,বি

আজ থেকে ৪০ বছর আগে সারা বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৪৬ লাখ শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যেত। এখন এই রোগে শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। দেশে এখন ১ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয় ডায়রিয়ায়। ১৯৬০ সালে মহাখালীতে কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরি (সিআরএল) স্থাপন করা হয়। পরবর্তী সময় ১৯৬২ সালে মুখে খাওয়ার স্যালাইন আবিষ্কার করে কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরি যার নাম দেওয়া হয় ঢাকা সলিউশন। সত্তরের দশকে সারা বিশ্বে যখন কলেরার তীব্রতা চলছিল, তখন মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট হার্সন প্রমাণ করলেন, পানি ও লবণের সঙ্গে গ্লুকোজ মেশালে গ্লুকোজ অন্ত্রের মধ্যে লবণ ও পানি টেনে নেয়, যা শরীরের পানিশূন্যতা পূরণে ব্যাপক কার্যকর। এটি ছিল ওআরএস আবিষ্কারের মূলনীতি। আইসিডিডিআর,বির এই উদ্ভাবন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওরস্যালাইনকে কার্যকর হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যা ছিল একটি যুগান্তকারী অর্জন। ওরস্যালাইনের জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ব্র্যাকের ভূমিকাও ছিল অবিস্মরণীয়। ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মীরা ওরস্যালাইন তৈরি ও প্রয়োগের নিয়ম সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে দেশব্যাপী বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ১৯৮৫ সাল থেকে এসএমসি প্যাকেটজাত ওরস্যালাইন বিতরণ শুরু করে। ১৯৮৭ সালের পর বাংলাদেশ সরকারও এই প্রোগ্রামটি তাদের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে। তিনি আরও বলেন, ওরস্যালাইনের ব্যবহার ও প্রয়োগ সম্পর্কে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক গণকর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন এবং আমাদের স্কুল পর্যায়েও সচেতনতা অভিযান পরিচালনা দরকার। যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের পরিবার ও প্রতিবেশীদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে পারবে। আমার মতে, আমাদের পাঠ্যপুস্তকে এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না তা বিবেচনা করা উচিত।

অনেক সময় লেগেছে ওরস্যালাইনকে আজকের এ অবস্থায় আসতে

ডা. সুকুমার সরকার,জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

আজকের ওরস্যালাইনকে এখানে পৌঁছানোর পেছনে একটি ইতিহাস রয়েছে। অনেক সময় লেগেছে ওরস্যালাইনকে আজকের এ অবস্থায় আসতে। এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ডায়রিয়া ম্যানেজমেন্টে আমাদের পারদর্শিতা। ওরস্যালাইন ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে অবদান রেখেছে এসএমসি। সেই ষাটের দশকে এটি তৈরি হয়েছে। ১৯৭১ সালে এর কার্যকরিতার ট্রায়াল হয়েছে। এরপর উৎপাদনে এসেছে। এসএমসি বিপণন শুরু করে ১৯৮৫ সাল থেকে। তখন এসএমসি ওআরএস সংগ্রহ করেছে রাষ্ট্রীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ইডিসিএল থেকে। তারও আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটি কর্মসূচির মাধ্যমে ঘরে ঘরে কুটিরশিল্পের মতো ওরস্যালাইন তৈরি হতো। তবে সেটা সহজলভ্য ছিল না। এসএমসি মার্কেটিং শুরু করল আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যেও ব্র্যাক জানায় ওআরএস মানুষের নাগালের মধ্যেই আছে, চাইলেই বানাতে পারে। তখন এক দশক ব্র্যাক লবণ-গুড় সলিউশন সারা দেশে প্রচারণা চালায়। ঘরে তৈরি স্যালাইন পানিশূন্যতা রোধে ভূমিকা রাখলেও প্যাকেট ওরস্যালাইন মৃত্যুহার কমাতে বড় ভূমিকা রাখে। ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই স্যালাইন ছড়িয়ে পড়েছে।

আগে মাতৃদুগ্ধ পরে ওরস্যালাইন

ডা. মুজিবুর রহমান,পরিচালক, শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট

নবজাতকের ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে ওরস্যালাইনের ভূমিকা অসাধারণ। নবজাতক বাঁচাতে মাতৃদুগ্ধের বিকল্প পৃথিবীতে আর নেই। মাতৃদুগ্ধকে যদি আমরা আরেকটু প্রমোট করতে পারি, তাহলে নবজাতক মৃত্যুহার কমে আসবে। বাংলাদেশে এখন প্রতি বছর ৬৬ হাজার নবজাতকের মৃত্যু হয়। আগে এটা ৭৫ হাজার ছিল। এই ৬৬ হাজারের ২১ শতাংশ হলো ইনফেকটিভ কজ। এই সংখ্যার মধ্যে ৩ থেকে ৪ হাজার নবজাতক মারা যাচ্ছে মূলত ডায়রিয়ায়। এখন বড় শিশুদের যখন ডায়রিয়া হয়, তখন সেটা ভাইরাল কজ। কিন্তু নিউনেটাল ডায়রিয়ার বেশি হয় ব্যাকটেরিয়াল কজ। সেক্ষেত্রে ওরস্যালাইন প্রয়োগের পাশাপাশি মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো গেলে শুধু ডায়রিয়া প্রতিরোধ করবে না; পাশাপাশি অন্যান্য রোগ প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখবে। সেক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কমে যাবে।

বড় শিশুদের ক্ষেত্রে আমরা বলি একসঙ্গে শিশু যতটুকু খেতে পারে, তাকে ওরস্যালাইন খেতে দিতে হবে। নবজাতকের ক্ষেত্রে বলি তাকে প্রথমে মায়ের বুকের দুধ খেতে দিতে হবে, এরপর যদি বাচ্চা কাঁদে তখন ওরস্যালাইন খাওয়ানোর পরামর্শ করব। নবজাতকের ক্ষেত্রে অল্প পরিমাণে খাওয়াতে হবে। একসঙ্গে বেশি ওরস্যালাইন নবজাতককে দিলে তখন বমির উদ্রেক হতে পারে।

ডিহাইড্রেশন অন্তঃসত্ত্বা মা ও শিশুর ওপর প্রভাব ফেলে

ডা. সারাবন তাহুরা,শিশু রেসপিরেটরি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, শিশু হাসপাতাল

মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অনেকের ধারণা, যখন দুধের শিশু অসুস্থ হয়, তখন মাকে ওরস্যালাইন খাওয়ানো হলে সেটি বেশি কার্যকর; কিন্তু একজন অন্তঃসত্ত্বা মায়ের যখন পানিশূন্যতা দেখা দেয়, তখন এ সমস্যা শিশুর ওপর প্রভাব ফেলে। এ বার্তাটি পরিষ্কারভাবে পৌঁছে দিতে হবে যে, সাধারণ মানুষের ডায়রিয়া বা পানিশূন্যতা হলে তিনি যেভাবে স্যালাইন খান একজন অন্তঃসত্ত্বাকেও সেভাবেই স্যালাইন খেতে হবে। সেই সন্তানসম্ভবার যদি পানিশূন্যতা হয়, সেক্ষেত্রে অ্যামনেটিক ফ্লুইডটা কমে যায়, ফলে তার অপুষ্ট সন্তান জন্ম হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে, গর্ভপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়। পাশাপাশি অ্যামনেস্টি ফ্লুইডের সঙ্গে যদি ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি দেখা দেয় সেক্ষেত্রে তালুকাটা, ঠোঁট কাটাসহ নিউরাল নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। অনেক সময় সকালে অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের শরীর খারাপ হলে দুই চামচ লবণ দিয়ে পানি পান করেন; কিন্তু এটা যে কত বড় ক্ষতি হচ্ছে, সেটা তারা বুঝতে পারেন না। তাদের এটা পরিহার করতে হবে। সবার কাছে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে, ওরস্যালাইন যতটুকু যেভাবে পরামর্শ দেওয়া হয় সেভাবেই খেতে হবে; এর একটুও এদিক-সেদিক হওয়ার অবকাশ নেই।

স্কুল-কলেজে ওয়েল বিয়িং ক্লাব করা যেতে পারে

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ,অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাবি

দেশে পাবলিক হেলথে দুটি বড় সফলতা এসেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় আবিষ্কার ওরস্যালাইন, আরেকটা অ্যান্টিবায়োটিক। আমাদের ভুলে, কিংবা অ্যান্টিবায়োটিকের দোষে হোক, এখন কিন্তু রেজিস্ট্যান্স হচ্ছে। পরবর্তী সময় যে মহামারি হবে সেটা অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে। বাংলাদেশে এখনই এটা মহামারি আকারে শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু ওরস্যালাইন জীবন রক্ষায় ভূমিকা রেখে চলছে। ওরস্যালাইন কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করে চলেছে। অর্থনীতির ভাষায় এই মানুষের জীবন অমূল্য। ধরুন, পাঁচ বছরের একটা শিশু বাবা-মায়ের সামনে মারা গেল। এতে বাবা-মায়ের যে ট্রমা হবে, তা আজীবন অপূরণীয়। এই জীবন রক্ষায় ওরস্যালাইনের যে অবদান, সেটা কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের চেয়ে কম নয়। সঠিক নিয়মে ওরস্যালাইন তৈরি এবং ডায়রিয়া বা পানিশূন্যতায় সেটি ব্যবহারের বিষয়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জনসচেতনতা গড়ে তোলা দরকার। আমরা স্কুল-কলেজে ওয়েল বিয়িং ক্লাব করা যেতে পারে। সেখানে ওরস্যালাইন ব্যবহার এবং আচরণ পরিবর্তনসহ বিভিন্ন জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক বিষয় শেখানো যেতে পারে।

শিক্ষিত অভিভাবকরাও ভুল করেন

ডা. সালাউদ্দিন আহমেদ,অধ্যাপক,বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল অ্যান্ড ইনস্টিটিউট

ওরস্যালাইন ডিহাইড্রেশনে লাগবেই; কিন্তু জানতে হবে, কীভাবে লাগবে কতটুকু লাগবে কী পরিমাণে লাগবে—পরিমাণে বেশি লাগবে, না কম লাগবে। আইসিডিডিআর,বি ঢাকা হাসপাতালে গত এপ্রিলে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৫০ জন শিক্ষিত মায়ের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করে। তাদের মধ্যে ওআরএস সম্পর্কে জানেন না ৮ শতাংশ। কীভাবে এটি বানাতে হয়, তা জানেন না ৭২ শতাংশ। সবচেয়ে কঠিন বিষয় হলো, তারা শিক্ষিত হওয়ার পরও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, স্যালাইন থেকে অ্যান্টিবায়োটিক বেশি ভালো। যেখানে আমরা জানি, ৯০ শতাংশ ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো কাজ নেই; বরং অ্যান্টিবায়োটিক খেলে উল্টো শরীরের ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলো ধ্বংস হয়।

চিকিৎসকের কাছে আসার আগেই আমার মনে হয়, এসব মা এক থেকে দুটি অ্যান্টিবায়োটিক খাইয়েই চিকিৎসকের কাছে আসেন। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, অনেকেই ঠিকভাবে স্যালাইন বানাতে জানেন না; এমনকি কতটুকু খাওয়াতে হবে, সেটিও জানেন না। পাশাপাশি ডায়রিয়া না হলেও একটু পাতলা পায়খানা হলেই অতিরিক্ত পরিমাণে ওআরএস খাওয়াচ্ছেন বা স্যালাইন খাওয়াচ্ছেন। শেষে আমার কাছে মনে হয়, ডায়রিয়া হলে খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে এই সচেতনতা অনেক বেড়েছে। তবে এখন সময় এসেছে কীভাবে স্যালাইন বানাতে হয়, কীভাবে খাওয়াতে হয়, কতটুকু খাওয়াতে হয়—এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা।

আবিষ্কারকরা নোবেল পাওয়ার যোগ্য

ডা. আতিয়ার রহমান,পেডিয়াট্রিক রেসপিরেটরি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, বিএমইউ

আমি মনে করি, যারা ওআরএস আবিষ্কার করেছেন তারা নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। অনেকেই অনেক আলোচনা করেছেন বাচ্চারা তো খেলাধুলা করবেই; কিন্তু যেটা হয় খেলাধুলা করলে শরীর থেকে পানি চলে যায়, এ সময় কিছু লবণও বের হয়। সেক্ষেত্রে সব সময় ওরস্যালাইন খাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এ বিষয়টা সমাধান হয়ে যায় শুধু পানি খেলে। কিছু মানুষ ঘামলেই স্যালাইন পান করেন, যেটা প্রয়োজন নেই সেটা করা ঠিক হবে না। সে ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা দেখা যায়। সুতরাং আমি বলব, আমাদের এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।

দুর্যোগপ্রবণ এলাকা নিয়ে ভাবতে হবে

কাজী আ.খ.ম. মহিউল ইসলাম,সাবেক মহাপরিচালক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর

দেশে দুর্যোগপ্রবণ এলাকা ২৫৭টি উপজেলা। এখানে সাড়ে ১১শ ইউনিয়ন আছে। ৬৪ জেলার ৫০ জেলার কোনো না কোনো অংশ দুর্যোগপ্রবণ। এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হয়। দেশের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে খুব প্রান্তিক এলাকা আছে। সেখানে ওরস্যালাইন সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে সরকারের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। সেইসঙ্গে কমিউনিটি এনগেইজড করতে হবে। কমিউনিটি এনগেইজ করা মানে বাচ্চাদের প্রাইমারি কেয়ার গিভার কিন্তু মা। তাই মাকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যাতে ওরস্যালাইন পৌঁছাতে দেরি হলে মা যেন স্যালাইন বানিয়ে পরিমিত উপায়ে খাওয়াতে পারেন। কারণ দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় পৌঁছানো কঠিন। দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় দ্রুততার সঙ্গে পৌঁছানোর উপায় নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। সবার আগে আমাদের কমিউনিটিকে সচেতন করতে হবে। আমি মনে করি, শিক্ষার চেয়ে বড় কোনো ওষুধ নেই।

সঠিক পরিমাণ স্যালাইন ব্যবহার জরুরি

বাবুল কুমার অধিকারী,বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদের চেয়ারপারসন

বিভিন্ন জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান স্যালাইনের ব্যবহারের বিষয়টি তৃণমূলে পৌঁছে দিয়েছে। যারা এই মহৎ কাজ করেছে, সেটাকে লক্ষ্য ধরে এগোতে হবে। লোনা পানির এলাকায় স্যালাইনের ব্যবহার কী হবে? কারণ ওখানে পানির লবণাক্ততার সঙ্গে স্যালাইনের লবণের পরিমাণ কি অতিরিক্ত হয়ে যাবে? আমি মনে করি, এটাও গবেষণা করা উচিত। আরেকটি বিষয়, রমজান মাসে স্যালাইনের ব্যবহার সাধারণত বাড়ে। এ সময় সঠিক নিয়মে স্যালাইন গ্রহণের বিষয়ে প্রচার কার্যক্রম চালানো যেতে পারে। এতে মানুষ সচেতন হবেন এবং সঠিক পরিমাণে স্যালাইন ব্যবহারে বিষয়ে ধারণা পাবেন।

অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে

অধ্যাপক ডা. মো. আবিদ হোসেন মোল্লা,শিশু বিশেষজ্ঞ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল

কোনো শিশু যদি এমন কোনো খাবার বা পানীয় খায়, যার মধ্যে কোনো রোগজীবাণু আছে, সেও কিন্তু সংক্রমণের শিকার। এই খাবারটা কিন্তু পাকস্থলীতেই যায়। সেখান থেকেই ডায়রিয়া দেখা দেয়। বাচ্চাদের যত রোগজীবাণু আছে এর মধ্যে ভাইরাস হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ভাইরাসের কথাটা এজন্য বিশেষভাবে উল্লেখ করছি, কারণ একটা বাচ্চা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে অনেক অভিভাবক ওরাল স্যালাইন না নিয়ে ওষুধের খোঁজে বের হন। কিন্তু এখানে একটা কথা স্পষ্ট করে বলছি, বাচ্চাদের ডায়রিয়ার জন্য যেসব কারণ দায়ী সেগুলোর মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ ভাইরাসের কারণে। ডায়রিয়া সম্পর্কিত মৃত্যু বা ক্ষতি যদি আমাদের কমাতে হয়, তাহলে ওরাল স্যালাইনের কোনো বিকল্প নেই। এ ছাড়া আরেকটি জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো জিংকের ব্যবহার। জিংক কিন্তু রক্ষণশীল বা প্রতিরক্ষামূলক আবহ তৈরি করে। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীকে সারিয়ে তোলার ক্ষেত্রে জিংক কিন্তু খুব ভালো কাজ করে। এজন্য ডায়রিয়া শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সঠিকভাবে এ সলিউশনটি তৈরি করার বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতনতায় আমাদের কাজ করতে হবে।

অনেক মানুষের স্যালাইন নিয়ে অজ্ঞতা রয়েছে

মো. মুসা মিয়া,পলিসি স্পেশালিস্ট , ব্র্যাকের অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জ

সবাই হয়তো স্যালাইন বানানোর প্রক্রিয়া জানেন না; কিন্তু আমি ছোটবেলায় দেখেছি, স্যালাইনের প্যাকেটের গায়ে একটা সিম্বল থাকত—দুটি গ্লাস, একটি স্যালাইনের প্যাকেট ও একটি জগের ছবি। এটা দিয়ে মানুষ বুঝতে পারত, কীভাবে একটি স্যালাইন বানাতে হয়; কিন্তু এখন এই সিম্বল না থাকায় অনেকেই এটা বুঝতে পারেন না। আমার মনে হয়, ওই সিম্বল পুনরায় ব্যবহারের মাধ্যমে আপনারা ওই সচেতনতা মানুষের মধ্যে তৈরি করতে পারবেন। আমরা গ্রাম পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, এখনো অনেক মানুষের মধ্যে স্যালাইন নিয়ে অজ্ঞতা রয়েছে।

সে ক্ষেত্রে আইসিডিডিআর,বি, ব্র্যাক ও এসএমসি একসঙ্গে কাজ করতে পারে। আরেকটি বিষয়, কতটুকু তাপমাত্রার মধ্যে এটি সংরক্ষণ করতে হবে সেটি প্যাকেটে লেখা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। এজন্য সঠিক তাপমাত্রায় রাখার বিষয়টি বিক্রেতাদের নিশ্চিত করার বিষয়ে নজর দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া ওআরএস ব্যবহারের ক্ষেত্রে জাতীয় কৌশল প্রণয়ন করা যেতে পারে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ওআরএস কর্নার করা যেতে পারে, একজন শিশু বা প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিদিন কটি স্যালাইন খেতে পারবে—সে বিষয়ে জানানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, জরুরি সময়ে স্যালাইনগুলো কীভাবে বণ্টন করা যেতে পারে, এ বিষয়ে নজর দেওয়া যেতে পারে।

সচেতনতাও জরুরি

সুমিতা মহাপাত্র,প্রধান শিক্ষক, আলহাজ আনোয়ার হোসেন শহীদ নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

প্রচণ্ড গরমের সময় শিশুরা বমি, ডায়রিয়াসহ নানা রকম সমস্যায় ভোগে। তারা হঠাৎ করেই শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এসব ক্ষেত্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেশিরভাগ শিশুই তীব্র গরমে অনেক খেলাধুলা করে এবং তৃষ্ণা নিবারণের জন্য বাইরে থেকে বিভিন্ন অস্বাস্থ্যকর পানীয় ও খাবার গ্রহণ করে। সেসব খাবার ও পানীয় সাময়িক স্বস্তি দিলেও শিশুদের শরীরে খারাপ প্রভাব সৃষ্টি হয়। এতে বিভিন্নভাবে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে যায়। এসব অপুষ্টিকর খাবারের বিষয়ে অভিভাবকরা অনেক সময় সচেতন নন। এক্ষেত্রে আমরা বাসায় গিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে বসে তাদের সচেতন করার চেষ্টা করি। আমরা তাদের সঠিক মাত্রায় স্যালাইন খেতে বলি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইউকেএম থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেলেন প্রধান উপদেষ্টা

চলন্ত নাগরদোলা থেকে ছিটকে ঝুলে গেলেন তরুণী

এবার ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বড় সিদ্ধান্ত নিল যুক্তরাজ্য

ঢাকায় টানা ৫ ঘণ্টা বৃষ্টির পূর্বাভাস

ইসরায়েলের শ্রমবাজার দখলে নিচ্ছে ভারতীয়রা, দেড় বছরে গেছে ২০ হাজার

১৩ আগস্ট : আজকের রাশিফলে কী আছে জেনে নিন

সৌদির জাহাজে করে আনা হচ্ছিল ইসরায়েলি অস্ত্র

অভিজ্ঞতা ছাড়া নিয়োগ দেবে ওয়ান ব্যাংক

মারা গেছেন বর্ষীয়ান অভিনেত্রী বাসন্তী

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের নতুন বার্তা

১০

সাড়ে ১২ লাখ টাকা নিয়ে নিখোঁজ, লাশ মিলল নদীতে

১১

ক্ষুধার কারণে মাথাব্যথা কীসের ইঙ্গিত

১২

টিভিতে আজকের খেলা

১৩

১৩ আগস্ট : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৪

১৩ আগস্ট : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৫

‘ভাড়াটিয়া কিলার দিয়ে আমার স্বামীকে হত্যা করেছে’

১৬

বুধবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১৭

এবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে জাহাজ কিনছে সরকার

১৮

আরাফাত রহমানের কবর জিয়ারত করল ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

১৯

স্বৈরাচার সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও অত্যাচারেই কোকোর মৃত্যু : আমিনুল হক

২০
X