অনেকেই শখ করে প্রাণী পোষেন। অনেকের প্রিয় একটি শখও বটে। কেউ কবুতর, কেউ টিয়া, কেউ ময়নাসহ নানা পাখি পোষেন। আবার কেউ কেউ কুকুর, বিড়াল কিংবা খরগোশসহ নানান চতুষ্পদ প্রাণীও পুষে থাকেন। তবে আজকাল ঘরে ঘরে সবচেয়ে বেশি যে প্রাণীর দেখা পাওয়া যায়, তা হলো বিড়াল। দেশি কিংবা বিদেশি কমবেশি সবার ঘরেই মেলে বিড়াল। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, বিড়াল পোষার বেশ কিছু উপকারিতা পাওয়া গেছে। এটা শুধু আপনাকে আনন্দই দেবে না, আপনার ঘরের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভূমিকা রাখতে সাহায্য করবে। আরও একটি মজার তথ্য হয়তো অনেকেরই অজানা, তা হলো—প্রতি বছর ৮ আগস্ট বিশ্ব বিড়াল দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এ উপলক্ষে এই প্রতিবেদনে রইল কয়েকজন বিড়ালপ্রেমীর গল্প। লিখেছেন- বৃষ্টি শেখ খাদিজা
স্বর্গ থেকে অরিও বলছি
আমি অরিও, পার্শিয়ান ক্যাট ছিলাম। শখের বসে কোনো এক পরিবার আমাকে নিয়েছিল। একসময় আমার ফাঙ্গাল ইনফেকশন দেখা দেয়। তাই তারা আমাকে ঘরে আর রাখেনি। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছিল। ঘরে পালা বিড়াল আমি, কী করে রাস্তায় থাকি বলো? না আছে খাবার, না আছে পানি। আমি ক্ষুধায় বালু খেয়েছি। একদিন এক অ্যাঞ্জেল স্টুডেন্ট মা ক্লাস শেষে আসার সময় আমাকে দেখে। আমি তার দিকে করুণভাবে তাকাই। সে আমাকে কোলে তুলে নেয়, পাশেই একটা ভেট দেখিয়ে এক মাসের একগাদা ওষুধ নিয়ে আমাকে ভয়ে ভয়ে বাসায় নিয়ে আসে। ভয়ের কারণ, বাসায় তাদের অনেক বিড়াল আর তোমরা তো জানো, ফাঙ্গাল ইনফেকশন খুবই ছোঁয়াচে। আমাকে একটা ছোট বারান্দায় রাখা হয়েছিল আলাদা করে—খাবার, পানি আর বিছানা দিয়ে। প্রথম দিন এসে আমি তিন ঘণ্টা শুধু খেয়েছি। কারণ, আমার যে পেটে অনেক ক্ষুধা ছিল। আমি দেখছিলাম মা আর বড় আম্মা আমার খাওয়া দেখে চোখে জল ফেলছে।
আমি দেখতাম, সবাই হাঁটাহাঁটি করত ঘরের মধ্যে, অন্য বিড়ালরা ছোটাছুটি করত কিন্তু আমি ওই বারান্দা ছেড়ে ঘরে আসতে পারিনি। মা সান্ত্বনা দিয়ে বলত, ‘আমার অরিও তুমি ভালো হলে ঘরে নিয়ে আসব, তুমিও খেলবে।’ আমাকে প্রতিদিন তিনবার মেডিসিন খাওয়াতে হতো, গায়ে ওষুধ মাখাতে হতো, প্রতিদিন স্পেশাল শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করাতে হতো। তখন ফাইনাল পরীক্ষা চলছে আমার মায়ের। তাও মা ইউনিভার্সিটি থেকে এসেই আমাকে নিয়ে সেবাযত্নে ব্যস্ত হয়ে যেত। মায়ের হাতে ফাঙ্গাল ইনফেকশন হয়ে গেল কিন্তু তাও মা মন খারাপ করল না, আমার সেবা কমায়নি। ঘরের সাতটা বিড়াল আমার দ্বারা ফাঙ্গাল ইনফেকটেড হলো। সবাইকে ট্রিটমেন্ট দেওয়া হলো নতুন করে। তাও দেখতাম মা আর বড়মা আশা করত আমি ভালো হব, সুন্দর হব। ২৭ দিনের দিন আমি মোটামুটি ভালো হলাম। আমাকে ঘরে নিল। আমি সারা ঘর ছুটে বেড়ালাম, খেলাম, স্বাধীনতার স্বাদ পেলাম, বাঁচার স্বপ্ন দেখলাম। ২৯ দিনের দিন আমার কী হলো জানি না, সারা গায়ে পচন ধরল, আসলে আমার ইনফেকশন ভেতরে ছড়িয়ে গিয়েছিল, সুখ কপালে সইল না। দুর্গন্ধ ছড়াত আমার শরীর থেকে। আমার চামড়া খুলে পড়ছিল, যেখানে বসতাম, সে জায়গাও নোংরা হয়ে যেত; তাও তারা আমাকে এতটুকু অবহেলা করেনি। কোলে নিত, গোসল করাত। ৩০ দিনের দিন আমি খাওয়া বন্ধ করলাম। ৩১ দিনের দিন আমার আর শরীর চলছিল না। তবুও আমার যত্ন কমায়নি, ভেটের সঙ্গে আলাপ করে ওষুধ খাওয়াচ্ছিল। আমার খুব বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছিল, যারা আমাকে ফেলে দিয়েছিল, মায়া করেনি কিন্তু এ স্টুডেন্ট মা-টা আমাকে এত যত্ন করেছে, আমার ইচ্ছে হচ্ছিল সারা জীবন তার সঙ্গে কাটিয়ে দিই আমি। আমার সুন্দর রূপ নিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়াই আর বলি—‘দেখো মা, তোমার কষ্ট সার্থক; আমি সুস্থ হয়েছি।’ কিন্তু আমি বাঁচতে পারলাম না। হয়তো আমি রাতেই মরে যেতে পারতাম কিন্তু আমি মা ঘুম থেকে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, মায়ের কোলে উঠব, মাকে দেখব তারপর দুনিয়া ছেড়ে যাব। মাকে না বলে কীভাবে বিদায় নিই বলো? মা ঘুম থেকে উঠল। আমি সর্বশক্তি দিয়ে পচা গন্ধযুক্ত শরীরটা নিয়ে নিজে গিয়ে মায়ের কোলে উঠলাম, মা কেঁদে জড়িয়ে নিল বুকে, মায়ের দিকে তাকালাম কয়েক মিনিটের মধ্যে হাসিমুখে দুনিয়া ছেড়ে স্বর্গে চলে আসলাম। আমি দেখলাম, মা হাউমাউ করে অরিও অরিও করে কাঁদছে আর বলছে—‘অরিও তোকে অনেক ভালোবাসি, কেন ছেড়ে গেলি? তোকে তো একটা সুন্দর জীবন দিতে চেয়েছিলাম, বোঝাতে চেয়েছিলাম সবাই ফেলে দেয় না, কেউ বুকে টেনে নেয়।’
মা আমাকে কবর দিয়েছে, রাস্তায় ফেলেনি। এখন আর আমার কষ্ট নেই জানো। কারণ, আমি স্বর্গে আছি। কষ্ট শুধু একটাই, সেটা ওই মায়ের জন্য যে বুকভরা আশা নিয়ে ৩১ দিন-রাত আমার প্রচুর সেবা করেছে। কিন্তু মাকে আমি আমার সুন্দর রূপের চেহারাটা উপহার দিতে পারলাম না, বলতে পারলাম না—‘মা, আমি তোমার ভালোবাসার কাছে ঋণী।’
যদি আমার মালিক আমাকে রাস্তায় ফেলে না দিত, শুরুতেই ট্রিটমেন্ট করত, হয়তো আমি বেঁচে যেতাম। ধিক্কার জানাই ওই মানুষরূপী পশুদের যারা আমাকে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল আর ভালোবাসা জানাই আমার সত্যিকারের অ্যাঞ্জেল মাকে, যে ৩১ দিন আমাকে সন্তান করে নিয়েছিল, ভুলিয়ে দিয়েছিল সব কষ্ট, বুঝিয়ে দিয়েছিল—‘তোমাকে ভালোবাসার জন্য আমি আছি। মন খারাপ করো না অরিও, আমি আছি তো তোমার পাশে…
মা, আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় আছি। তুমি যখন আসবে কোনো একদিন, আমি তোমাকে প্রাণভরে আদর করব, ভালোবাসা ফিরিয়ে দেব।
পোষ্যকে হারানোর কষ্টে অরিওর হয়েই কথাগুলো বলেছেন নারুটো অ্যান্ড ফ্যামিলির স্বত্বাধিকারী সেহেলী শিমুল
বেঁচে থাকার উৎসাহ পাই রোজ
আমার তিনটি বিড়াল—বিল্লু, পিচু আর কটন। এদের মধ্যে সবচেয়ে গভীর একটা বন্ধন তৈরি হয়েছে আমার আর বিল্লুর মধ্যে। বিল্লু অন্য বিড়ালের মতো অতটা এক্সপ্রেসিভ নয়। গা ঘেঁষে থাকে না, ডাকলে পাত্তা দেয় না। কিন্তু আমি যখন সারা দিনের পর ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরি, তখন সে যেখানেই থাকুক না কেন, দৌড়ে আমার কাছে ছুটে আসে। কোলে উঠে পড়ে, মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট করে বুঝিয়ে দেয়—সে আমাকে মিস করেছে। তখন ও চুপচাপ থাকে। খুব বেশি না, মাত্র পাঁচ মিনিট। মাথা নিচু করে, চোখ বুজে আমার আদর নেয়। আর আমি? এই পাঁচ মিনিটেই যেন সব ক্লান্তি, সব হতাশা ভুলে যাই। মনে হয় জীবনের যত কষ্ট আছে, কোনোটা আমাকে ছুঁতে পারবে না। মাঝেমধ্যে মনে হয়, যদি বিল্লু না থাকত, আমার জীবন হয়তো থেমে যেত। আমার আর বিল্লুর সেই নীরব পাঁচ মিনিটের আশ্রয়েই আমি বেঁচে থাকার উৎসাহ পাই রোজ। এ সময় মনে হয়, জীবনটা হয়তো এতটাও অসুন্দর নয়। বেঁচে থাকুক আমার বিল্লু, যতদিন আমি বাঁচি।
আফসানা রিপা
অদৃশ্য সুতোর বন্ধন
বিকেলের এক নিভৃতে সময়, যখন সূর্যের মৃদু আলো তার অপূর্ব সোনালি আভা ছড়িয়ে দিচ্ছিল, তখনই প্রথমবারের মতো আমার জীবনে এলো সে—একটি ছোট্ট, আঁধার-সোনা রঙা বিড়াল। দেখতে ভাপা পিঠার মতো রং, তাই নাম দিলাম ভাপা!
প্রথমে দেখা দিচ্ছিল একেবারে হঠাৎ, নির্দিষ্ট কোনো অনুসন্ধান ছাড়াই। একেবারে নিভৃতে, যেন সে নিজেই একটা গোপন উপহারতুল্য। এর আকর্ষণীয় চোখ দুটি, সূক্ষ্ম নেকড়ে নড়াচড়ায়, আমার অন্তর আলোকিত করল।
প্রথম সখ্য হলো আদর্শ—একেক টুকরো ফিডিংয়ের আসরে দাঁড়িয়ে থেকে সে লাজুক, কিন্তু নির্ভয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। যেমন এক আত্মার প্রতিরূপ, রাতের কুঁজে থাকা মৃদু আলোতে ঘুরে বেড়ায়। আমি ধীরে ধীরে খেতে দিই। পায়ের কাছে নরম লম্বা দেহ পেতে বসে আর একটা মৃদু গর্জন—নরম সুর, যেন মনে করিয়ে দেয়, ‘আমি আছি, তোমার পাশে।’
এর পরের কিছুদিন, অন্তরজুড়ে এ সম্পর্ক আরও ঘনীভূত হতে থাকে। সন্ধ্যায় অন্ধকার নেমে এলে, আমি বই পড়ি আর সে সেখানে আসে লাজুকভাবে, কাঁধে কিংবা পাশে গা মেলায়। মায়ার অনুভূতি সে যেন নিঃসন্দেহে দেয়—অনেক সংকটের মাঝে যেন একান্ত এক মমতার বন্ধন।
হঠাৎ একদিন, আমার মন খারাপ; কর্মবিরতিতে হারিয়ে গিয়েছিলাম নিজেকে। তখনই সে আসে। মাথা টেনে নেয় আমার কোলে আর সে মৃদু মাথা চেপে দেয়—এক নিঃশব্দ কথোপকথন। আমি দেখলাম, সে কিছু বলতে চাচ্ছে—‘তুমি একা নও, আমি আছি।’ এ ছোট্ট কথা একসঙ্গে গড়ে তোলে অটুট সখ্যের এক নিঃশব্দ সেতু।
এক ঝড়ের রাত, সে ভীত—অন্ধকার, বজ্রনিনাদ ও আকাশ থেকে পড়ে আসা বৃষ্টির শব্দ—সবকিছুই যেন দূর হতে শুরু করে আমার সঙ্গে থেকে, শুধু সে আর আমি, দুটি আত্মা এক মৃদু শান্তিতে বাঁধা। সেই পারস্পরিক সহানুভূতি, অবিচ্ছিন্ন সখ্য—সে মুহূর্ত আমার কাছে অমলিন হয়ে থাকে।
আজও যখন আমি বাসায় ফিরি, সে প্রথমে আসে দরজায়—নীরবভাবে অপেক্ষা করে। ছোট ছোট লেজের দোলা, চোখে আগ্রহ, যেন এক কথা বলতে চাইছে—‘তুমি ফিরে এসে ভালো করেছ।’ আমি ছুঁয়ে দেখি তার নরম লোম আর ভালোবাসায় ভরে ওঠে অন্তর—মায়া, গভীর সখ্য, নিঃশর্ত ভালোবাসা।
আমরা দুজন—মানব আর বিড়াল—একটি অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ। ভাষা ছাড়াই, চোখে চোখে, মৃদু স্পর্শে। দিনের প্রতিটি ছোট মুহূর্তে, সে আমার পাশে থেকে বোঝায়—প্রতিটি সঙ্গ হলো এক অনন্য আশীর্বাদ। তার সেই নির্জন উপস্থিতিই আমার জীবনে এনে দেয় শান্তি, মায়া, ভালোবাসা—এক দৃঢ়, নির্ভরযোগ্য বন্ধুত্ব।
এমনই একটি সখ্য—নিখাদ, বিনয়ী, হৃদয়ের গভীরতা ছুঁয়ে গিয়ে অম্লান হয়ে থাকা সেই মায়া; যা মানুষ এবং বিড়ালের মাঝে প্রতিদিন অনবদ্যভাবে তৈরি হয়।
ফুয়াদ রুহানী খান
ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করে
আমার বিড়াল আমার সন্তান। তাদের সন্তানের মতোই লালনপালন করি। আমি চার বছর ধরে বিড়াল পালি। একটা সময় এমন ছিল, আমি বিড়াল অনেক ভয় পেতাম। তাদের কারণেই আজ আমি সেই ভয়কে জয় করা শিখেছি। বেলা, টুনি, চার্লি, ইরা—এ চারজন আমার সন্তান। দিনশেষে বাসায় গেলে ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করে। ওদের মায়া চেহারা আমাকে মানসিক শান্তি দেয়। বিড়াল অন্য সবার জন্য একটা প্রাণী কিন্তু আমার চোখে ও আমার পরিবারের একজন সদস্য।
সর্বোপরি, বিড়াল আপনার অবসর সময়ের খুব ভালো একজন বন্ধু ও সঙ্গী হতে পারে। আপনার অবসর সময়গুলো আপনি পোষা বিড়ালের সঙ্গে কাটাতে পারেন, যা আপনাকে আনন্দ ও প্রশান্তি এনে দেবে। তাই যারা প্রাণী পুষতে পছন্দ করেন, তারা কুকুরের পরিবর্তে বিড়াল পুষতে পারেন। এটা একদিকে যেমন আপনাকে উপকৃত করবে, অন্যদিকে কারও কোনো ক্ষতিও করবে না।
তানজীম তাবাস্সুম অন্তরা
সর্বোপরি, বিড়াল আপনার অবসর সময়ের খুব ভালো একজন বন্ধু ও সঙ্গী হতে পারে। আপনার অবসর সময়গুলো আপনি পোষা বিড়ালের সঙ্গে কাটাতে পারেন, যা আপনাকে আনন্দ ও প্রশান্তি এনে দেবে। তাই যারা প্রাণী পুষতে পছন্দ করেন, তারা কুকুরের পরিবর্তে বিড়াল পুষতে পারেন। এটা একদিকে যেমন আপনাকে উপকৃত করবে, অন্যদিকে কারও কোনো ক্ষতিও করবে না।
মন্তব্য করুন