মৃত্যুর ৩৩ বছর পর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দ্বিতীয় বেসামরিক সম্মাননা পদক একুশে পদক পেতে যাচ্ছেন বাংলা গানের জগতে তরুণদের কাছে জনপ্রিয় ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখ গানের গীতিকার ও ৭৫ এর অন্ধকার সময়ের অসংখ্য প্রতিবাদী কবিতার স্রষ্টা কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
ভাষা আন্দোলন, শিল্পকলা, ভাষা ও সাহিত্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এবারের একুশে পদক পাচ্ছেন ২১ জন। তাদের মধ্যে প্রয়াত কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহসহ ছয়জন মরণোত্তর এ সম্মাননা পাচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে মৃত্যুর ৩৩ বছর পর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাচ্ছেন।
দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখায় ২১ বিশিষ্টজনকে ‘একুশে পদক ২০২৪’ দেওয়া হচ্ছে আজ মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি)। সকাল ১১টায় রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে মনোনীতদের হাতে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘একুশে পদক’ তুলে দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পদক বিতরণের আগে সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) পৃথক বাণীতে মনোনীতদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশাল রেডক্রস হাসপাতালে। তার পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পিতৃদত্ত নাম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ছোটবেলায় এই নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। লেখালেখির জগতে এসে নামটি তিনি নিজেই বদলে দেন। নামের আগে যোগ করেন ‘রুদ্র’, ‘মোহাম্মদ’-কে করেন ‘মুহম্মদ’ আর ‘শহীদুল্লাহ’-কে ‘শহিদুল্লাহ’। নিজ প্রদত্ত এই নাম শুধু লেখক হিসেবেই নয়, পরীক্ষার সনদেও তিনি ব্যবহার করেছেন এই নাম। তার মায়ের নাম শিরিয়া বেগম, বাবার নাম শেখ ওয়ালীউল্লাহ। তাদের স্থায়ী নিবাস ছিল বাগেরহাট জেলার মংলা থানার সাহেবের মেঠ গ্রামে। রুদ্রর নিজ বাড়ি সাহেবের মেঠ থেকে তার নানা বাড়ি মিঠেখালি খুব বেশি দূরে ছিল না। নানাবাড়ির পাঠশালায় ৩য় শ্রেণী অবধি পড়েন রুদ্র, এরপর ১৯৬৬ সালে ৪র্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন মংলা থানা সদরের সেইন্ট পলস স্কুলে। এই স্কুলেই রুদ্র একসময় ৯ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। ’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তার আর ৯ম শ্রেণিতে পড়া হয়নি। যুদ্ধ শেষে ৯ম শ্রেণী টপকিয়ে কবি ১০ম শ্রেণিতে ভর্তি হন ঢাকার ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলে। এখান থেকেই ১৯৭৩ সালে ৪টি বিষয়ে লেটার মার্কসহ বিজ্ঞান শাখায় ১ম বিভাগে রুদ্র এসএসসি পাস করেন। এরপরে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। পিতামাতার ইচ্ছা ছিল, রুদ্র ডাক্তার হোক। কিন্তু রুদ্র বিজ্ঞানের পথে আর না গিয়ে তার পছন্দের মানবিক শাখায় চলে এলেন।ঢাকা কলেজে এসে রুদ্র পুরোপুরি সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করলেন। ১৯৭৫ সালে রুদ্র উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ২য় বিভাগে। দু’বছরে তিনি ক্লাস করেছিলেন মাত্র ১৮টি। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি হন বাংলা বিভাগে। ১৯৭৮ সালে রুদ্র ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মনোনয়নে সাহিত্য সম্পাদক পদে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কামাল চৌধুরী (ছাত্রলীগ) ও আলী রিয়াজ (জাসদ ছাত্রলীগ)। সেবার সাহিত্য সম্পাদক হন আলী রিয়াজ। রুদ্র সরাসরি কখনো রাজনীতিতে না এলেও ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রকাশ করেন তার রাজনৈতিক বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস টিকে ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। রুদ্র ছিলেন ঢাবির সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র। কিন্তু তিনি বেশি থাকতেন ফজলুল হক হলে বন্ধু কামাল চৌধুরীর ৩০৯ নাম্বার কক্ষে অথবা রেজা সেলিমের ১১০ নাম্বার কক্ষে। ১৯৭৯ সালে রুদ্রর অনার্স পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ক্লাসে উপস্থিতির হার কম থাকায় বাংলা বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান ডক্টর আহমদ শরীফ তাকে পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি দেননি। পরের বছর, ১৯৮০ সালে তিনি অনার্স পাস করেন। এরপর নানা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় আবারও পিছিয়ে পড়েন রুদ্র। ১৯৮৩ সালে নেন এমএ ডিগ্রি। ছাত্রজীবনেই রুদ্রর দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, ‘উপদ্রুত উপকূল’ আর ‘ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম’। প্রথম বইটির প্রকাশক ছিলেন আহমদ ছফা। দুটি বইয়ের জন্যেই রুদ্র যথাক্রমে ১৯৮০ ও ১৯৮১ সালে সংস্কৃতি সংসদ প্রবর্তিত মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন। রুদ্র ছিলেন জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা-যুগ্ম সম্পাদক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রথম আহবায়ক কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ সঙ্গীত পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও প্রকাশনা সচিব। তিনি বিয়ে করেন ২৯ জানুয়ারি, ১৯৮১ সালে। স্ত্রীর নাম লীমা নাসরিন। পরবর্তীকালে তিনি তসলিমা নাসরিন নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন ও নিজের বিতর্কিত লেখালেখির জন্য আলোচিত হন।
১৯৮৬ সালে উভয়ের সম্মতিতে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। তার তসলিমার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পর জীবন ছিল অনিয়ন্ত্রিত।শরীরের উপর যথেষ্ট অত্যাচার করতেন। তুখোড় অনিয়মের কারণে বাঁধিয়েছিলেন পাকস্থলীর আলসার। পায়ের আঙুলে হয়েছিল বার্জার্স ডিজিজ। গুরুত্ব তিনি কখনোই দেননি এসবকে অসুস্থতা নিয়েও তিনি ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে যেতেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে পর্যন্ত তিনি সাহিত্য আড্ডায় ছিলেন। রুদ্র পেপটিক আলসার বাঁধিয়ে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের ২৩১ নাম্বার কেবিনে ছিলেন। সপ্তাহখানেক থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ২০জুন রুদ্র বাসায় ফেরেন। পরের দিন ২১ জুন, ১৯৯১ সালে মারা যায়। রুদ্রর মৃত্যু সংবাদ মুহূর্তের দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। দেশে ও দেশের বাইরে থাকা কবির বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের মাঝে শোক নেমে আসে।
মন্তব্য করুন