সাবেক ধর্মমন্ত্রী, বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সোমবার (২৮ আগস্ট) বাদ আসর ময়মনসিংহ নগরীর আঞ্জুমান ঈদগাহ মাঠে জানাজায় অংশ নিতে ঢল নামে সর্বস্তরের মানুষের।
জানাজার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকসহ প্রতিনিধি দল শ্রদ্ধা জানায়। পরে একে একে শ্রদ্ধা জানায় বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
আগামীকাল মঙ্গলবার নগরের আকুয়ায় দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে মরহুমের মরদেহ দাফন করা হবে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক কার্যনির্বাহী সদস্য অধ্যক্ষ মতিউর রহমান ছিলেন ময়মনসিংহের রাজনৈতিক অঙ্গনের অবিসংবাদিত নেতা। স্থানীয় রাজনীতির বটবৃক্ষ ও সিংহপুরুষ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় তাকে। বর্ষীয়ান এ রাজনীতিকের চির বিদায়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে ময়মনসিংহে।
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও সাধারণ মানুষও শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছে। মতিউর রহমানের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশের জন্য এদিন নগরের বিভিন্ন এলাকার বিপণিবিতান বন্ধ রাখা হয়। পরপারে শান্তি চেয়ে ফেসবুকে হৃদয়বিদারক স্ট্যাটাস দিয়েছেন নেটিজেনরাও।
গতকাল রাত ১১টার দিকে ময়মনসিংহ নগরীর ধোপাখোলা এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন অধ্যক্ষ মতিউর রহমান।
জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন তিনি। তিনি স্ত্রী, এক পুত্র ও দুই কন্যাসহ অসংখ্য শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন।
কীর্তিমান এ রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসনের এমপি বেগম রওশন এরশাদ, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ এমপি, গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ এমপি, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র ইকরামুল হক টিটু, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. এমদাদুল হক চৌধুরীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক পেশাজীবী ও সব শ্রেণি-পেশার মানুষ।
এদিকে আজ সকাল থেকে নগরীর আলমগীর মনসুর মিন্টু মেমোরিয়াল কলেজ প্রাঙ্গণে মরহুমের মরদেহ রাখা হয় সবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। মতিউর রহমানকে শেষবার দেখতে কলেজ মাঠে আসেন দলমত-নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ। এ সময় জাতীয় সংসদের হুইপ আতিকুর রহমান আতিক, সিটি মেয়র, বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠন ও হাজারো মানুষ মরহুমের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। পরে বাদ আসর ময়মনসিংহ নগরীর আঞ্জুমান ঈদগাহ মাঠে মরহুমের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
এর আগে, শোক জানিয়ে বক্তব্য রাখেন- কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু, ধর্মপ্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মশিউর রহমান হুমায়ুন, সিটি মেয়র ইকরামুল হক টিটু, মরহুমের ছেলে ও ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহিত উর রহমান প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহকে মুক্ত ঘোষণা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে গত বছর একুশে পদক পান সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম এই নেতা।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ১৯৫৮ সালে আওয়ামী রাজনীতিতে নাম লেখানো অবিনশ্বর এই নেতা হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালার মতো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শতলে ভিড়িয়েছেন অসংখ্য মানুষকে।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে দীর্ঘ ২৩ মাস কারাবরণও করেন। তিনি ২০০২ সালে ময়মনসিংহের চারটি সিনেমা হলে বোমা হামলার মিথ্যা মামলাতেও কারাবরণ করেন। শত প্রলোভনের মুখে আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রতি অবিচল থেকে তিনি তার সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনে পিছপা হননি।
সাংগঠনিক জীবনে অধ্যক্ষ মতিউর রহমান দুইবার ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে ১৯৯৬ সাল থেকে টানা ১৮ বছর দায়িত্ব পালন করেন।
দলীয় নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য ও জাতীয় স্বার্থে ত্যাগ স্বীকারের কারণে ১২ জানুয়ারি ২০১৪ থেকে ৬ জানুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত মতিউর রহমান ধর্মমন্ত্রী (টেকনোক্র্যাট কোটা) হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসন থেকে ১৯৮৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের অর্থ মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয়, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও জাতীয় সার সমন্বয় ও বিতরণ কমিটি এবং বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সদস্য, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্ন্যান্সের গভর্নর, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এ ছাড়াও তিনি ১৯৯৬ সালে একবার বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য এবং ২০০৮ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তিনবার সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর থেকে মোট তিনবার তৎকালীন ময়মনসিংহ পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যানও ছিলেন আলহাজ অধ্যক্ষ মতিউর রহমান।
সাবেক ধর্মমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মতিউর রহমান ১৯৪২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার আকুয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
মন্তব্য করুন