খুলনার কয়রা সদরে সরকারি কোনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স না থাকায় স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন লক্ষাধিক মানুষ। উপজেলা সদর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কয়রার আমাদী ইউনিয়নের জায়গীর মহালে অবস্থিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। যেখানে যেতে সময় ও অর্থ দুই দিক থেকেই চরম ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কয়রা সদরের সাধারণ মানুষের জন্য।
যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় সহজে কেউ দূরে আমাদী ইউনিয়নে অবস্থিত উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে পারেন না। এ জনপদের অধিকাংশ মানুষ জেলা শহরে গিয়ে ভালো চিকিৎসা করাতেও ব্যর্থ হন। ফলে সময়মতো চিকিৎসা না পেয়ে অনেকে তাদের প্রিয়জনদের হারাচ্ছেন।
জানা গেছে, বেদকাশী-কয়রা এলাকার জন্য একটি মাত্র উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকলেও সেখানে নেই কোনো ভবন, রোগীদের সেবা দেওয়ার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, ওষুধ ও চিকিৎসক সংকটে প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে। আগে একজন ফার্মাসিস্ট দিয়ে পরিচালিত হতো সদরের এ উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রটি। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরে এ উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ফার্মাসিস্টকে বদলি করা হলে সেই স্থানে নতুন কেউ যোগদান করেনি। কয়েক মাস ধরে ঝুলছে তালা, ফলে জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হলে রোগীদের যেতে হয় ১৭ কিলোমিটার দূরের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অথবা পাইকগাছা কিংবা খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। দুর্গম সড়কপথ এবং নদীপথের কারণে অনেক সময়ই রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে।
এদিকে কয়রার পাঁচটি ইউনিয়ন, বাগালী, মহেশ্বরীপুর, মহারাজপুর, উত্তর বেদকাশী,ও দক্ষিণ বেদকাশীতে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও সেটা খাতাকলমে সীমাবদ্ধ। সেখানে নেই কোনো চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র। ফলে ভোগান্তিতে পাড়ি জমাতে হয় দূরের হাসপাতালে। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নিতে যেতে হয় কয়রা উপজেলা আমাদীর জায়গীর মহালে অবস্থিত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে যেতে একমাত্র নদী পথই তাদের ভরসা। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় অনেক অসুস্থ মানুষ চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে যাওয়ার পথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়।
স্থানীয়রা জানান, উপজেলা সদরে যেখানে লক্ষাধিক মানুষের বাস। অনন্য ইউনিয়ন থেকে উপজেলা সদরে মানুষের আসা-যাওয়া বেশি। সেখানে একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকা অত্যন্ত জরুরি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি উপজেলায় একটি করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকার কথা, সেটা আছেও কিন্তু উপজেলা সদর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরের আমাদী ইউনিয়নে অবস্থিত হওয়া দূরত্বের কারণে সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
তারা আরও জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হলেও চাহিদার তুলনায় সেটা পর্যাপ্ত নয়। তবে স্থানীয়দের দাবিতে কয়রা সদরে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একটি প্রস্তাবনা থাকলেও নানা জটিলতায় আজও বাস্তবায়ন সম্ভাব হয়নি।
দক্ষিণ বেদকাশীর বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের বাড়ি থেকে কয়রা সদর ১৭ কিলোমিটার এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দূরত্ব ৩১ কিলোমিটার। কিন্তু আমাদের ইউনিয়নে একটি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকলেও সেখানে কোনো চিকিৎসক থাকে না। কোনো মানুষ অসুস্থ হলে চিকিৎসা সেবা নিতে হলে নৌকা কিংবা ট্রলারে করে উপজেলা সদরে আসতে হয়। সদরে পৌঁছাতে ৩-৪ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। অনেক সময় প্রাথমিক চিকিৎসার অভাবে মারা যায় মানুষ।
উপকূল ও সুন্দরবন সুরক্ষা আন্দোলন কমিটি কয়রার আহ্বায়ক এম আনোয়ার হোসেন বলেন, কয়রা সদরে থানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই আমাদের জায়গীরমহল নামক স্থানে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স স্থাপিত হয়। বর্তমান সেটা উপজেলা সদর থেকে ১৭ ও দক্ষিণ বেদকাশী থেকে ৩১ কিমি দূরে। এমন অবস্থায় উপকূলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের জন্য উপজেলা সদরে একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণের জোর দাবি জানাই।
কয়রা সদরের ২ নম্বর কয়রা গ্রামের শেখ সালাহউদ্দীন লিটন বলেন, কয়রা-বেদকাশী একটি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকলেও সেই ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। ঠিকমতো ডাক্তার আসে না, ওষুধও পাওয়া যায় না। রোগীরা যায় আর হতাশা নিয়ে ফিরে আসে। বর্তমানে সেটা বন্ধ আছে। যদি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রটি চালু ও উপজেলা সদরে একটি হাসপাতাল থাকত, তাহলে চিকিৎসা সেবা নিতে মানুষের এত দূরে যেতে হতো না।
কয়রা কপোতাক্ষ কলেজের সাবেক অধ্যাপক আ. ব. ম আব্দুল মালেক বলেন, উপজেলা সদরে একটি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের চাওয়া। একটি প্রস্তাবনা থাকলেও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। তবে কয়রার উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো চালু করে কর্মকর্তা-কর্মচারী পদায়ন দিয়ে উপজেলা সদরে বসার সুযোগ করে দিলে এলাকাবাসী স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হত না।
স্বাস্থ্য বিভাগ খুলনার পরিচালক ডা. মো. মনজুরুল মুরশিদ বলেন, কয়রা সদরে একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। তবে কয়রায় ইউনিয়ন ও উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকলেও সেখানে কোনো চিকিৎসক নেই। কার্যক্রমও একেবারে বন্ধ। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মেডিকেল অফিসার সব জায়গায় কম, যে কারণে আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতেও দুজন, তিনজনের বেশি চিকিৎসক নেই। নতুন নিয়োগে কিছু মেডিকেল অফিসার নেবে, সেটা নিলে হয়তো সংকট কেটে যাবে।
মন্তব্য করুন