সাইদুল ইসলাম, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৫, ১০:৫৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেলপথ

লোকাল ট্রেনের ব্যবস্থাপনায় চলছে ৪ আন্তঃনগর ট্রেন

দোহাজারী রেলপথ। ছবি : সংগৃহীত
দোহাজারী রেলপথ। ছবি : সংগৃহীত

একসময় জনপ্রিয় আঞ্চলিক রেল রুট ছিল চট্টগ্রাম-দোহাজারী। তখন প্রতিদিন এই রুটে ৬-৭ জোড়া ট্রেন চলাচল করত। সংযোগকারী কালুরঘাট সেতু জরাজীর্ণ হওয়ায় ট্রেনের সংখ্যা নেমে আসে একটিতে। সেতুটি সংস্কার করে ২০২৩ সালে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের পর চট্টগ্রাম-দোহাজারী সেকশনটি আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

এখন প্রতিদিন চারটি আন্তঃনগর (পর্যটক ও কক্সবাজার) ছাড়াও সপ্তাহে ৪-৫ দিন চলে জ্বালানিবাহী ট্রেন। হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠলেও সেকশনটির অপারেটিং কার্যক্রম এখনো চলছে পুরোনো ধাঁচে। এতে দুর্ঘটনাপ্রবণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ।

ঢাকা-চট্টগ্রাম ছাড়াও দোহাজারী-কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ চলছে কম্পিউটার বেজড ইন্টারলকিং (সিবিআই) পদ্ধতিতে। কিন্তু দীর্ঘদিনের পুরোনো রেলপথ হওয়ায় চট্টগ্রাম-দোহাজারী এখনো ম্যানুয়াল পদ্ধতির সিগন্যাল দিয়েই চলছে। সর্বশেষ গত ৬ জুন রাতে কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনের ধাক্কায় কালুরঘাট সেতুর বোয়ালখালী অংশে বেশ কয়েকটি যানবাহন দুর্ঘটনার মুখে পড়ে।

এতে তিনজন মারা যাওয়ার পাশাপাশি অনেকে আহত হন। এর দুই দিন পর একই স্থানে রেলের নিয়ম অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ সেতুতে ওঠার গতি নিয়ন্ত্রণাদেশ অমান্য করে আরেকটি ট্রেন সেতুতে উঠে যায়। ওই সময় সেতুতে যানবাহন না থাকায় দুর্ঘটনা না ঘটলেও যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন রেলওয়ে সংশ্লিষ্টসহ স্থানীয়রা।

মূলত ওই দিন পূর্ববর্তী গোমদণ্ডী স্টেশন থেকে পেপার লাইন ক্লিয়ারেন্স বা পিএলসি নিয়ে ট্রেনটি কালুরঘাটের দিকে আসতে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী ট্রেনটি সেতুতে ওঠার আগে কেবিনে (কেবিন-বি) থেমে চৌকিদার বইয়ে স্বাক্ষর করার কথা। স্বাক্ষর করার পর চালক (লোকোমাস্টার) মাত্র ১০ কিলোমিটার গতিবেগে সেতু পার হওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু পর্যটক ট্রেনের চালক সেটি অমান্য করায় সেতুর মধ্যে থাকা যানবাহনে ধাক্কা দেয়।

রেলসেতুটিতে দীর্ঘদিন ধরে যানবাহন চলাচল করলেও পিএলসি প্রাপ্ত একটি ট্রেন পূর্ববর্তী স্টেশন ছেড়ে আসার পর সেতুতে কোনো যানবাহন থাকার কথা নয়। মূলত চালক নিয়ম অমান্য করে কেবিনে থাকা চৌকিদার বইতে স্বাক্ষর না করে ১০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে ট্রেন চালানোয় বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। আবার আগের স্টেশন থেকে লাইন ক্লিয়ার দেওয়ার পরও সেতুতে যানবাহন থাকায় এই সেতুটিতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।

মূলত দুর্ঘটনার শুরু থেকেই কেবিন ঘরের সামনে না থেমে চালকের সেতু পার হওয়ার চেষ্টাকে প্রাথমিকভাবে দায়ী করে চালকসহ সংশ্লিষ্ট চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন, সেতুর পূর্ববর্তী স্টেশন থেকে লাইন ক্লিয়ারেন্স দেওয়ার পর রেললাইনে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকার কথা নয়। চালক নিয়ম মানলেও সেতুতে যানবাহন থাকলে দুর্ঘটনা ঘটবে। এজন্য গুরুত্বপূর্ণ রেলপথে মান্ধাতার আমলের পদ্ধতির ব্যবহার, অপারেটিংয়ে স্বল্প জনবল ছাড়াও মনিটরিং কার্যক্রমের দুর্বলতাকে দায়ী করেছেন তারা।

রেলওয়ের পরিবহন ও রানিং স্টাফরা বলেন, কালুরঘাট সেতুর উভয় পাড়ের কেবিনটি সেতুর খুবই সন্নিকটে। যার কারণে ডেড স্টপে থামার আগে ট্রেনটিকে সেতুর একেবারেই মুখে চলে আসতে হয়। মূল লাইন থেকে সেতুতে তুলতে ট্রেন শতভাগ থামানো কঠিন হয়ে যায়। সাধারণ রেললাইন থেকে সেতু অনেক উঁচু হওয়ায় অনেক ট্রেনচালকই ট্রেন থামানোর বিষয়টি অবহেলা করতে চাইছে।

আবার কেবিন সংলগ্ন রেললাইনের দুই পাশে ঘন গাছপালার কারণে দূর থেকে চালক সেতু ও সেতুর উপরিভাগের সড়কে যানবাহনের উপস্থিতি টের পায় না। যার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। আগামীতে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে রেলওয়েকে আরও বেশি সজাগ ও আধুনিক ট্রাফিক সিস্টেম প্রবর্তন করতে হবে বলে জানিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেন, কালুরঘাট সেতুতে ট্রেন চালানোর জন্য ১০ কিলোমিটার গতিবেগের স্পিড রেস্ট্রিকশন বা গতি নিয়ন্ত্রণাদেশ রয়েছে। এই নিয়ম প্রতিপালনে ট্রেন না থামিয়েও চৌকিদার বইতে সই করতে পারেন। পূর্ববর্তী স্টেশন থেকে পিএলসি দেওয়ার পরও কেন সেতুতে যানবাহন থাকবে, সেই বিষয়টিও খতিয়ে দেখা দরকার। গতি নিয়ন্ত্রণাদেশ শুধু সেতু ও ট্রেনের নিরাপত্তার জন্য, যানবাহন সেতুতে রেখে লাইন ক্লিয়ারেন্স দিয়ে ট্রেন চলাচলকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন তিনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এরই মধ্যে কয়েক দফায় সেতুটির দুই পাশ থেকে চৌকিদার প্রত্যাহার করে নিয়েছিল রেলওয়ে। পরে স্থানীয় স্টেশন মাস্টারদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ফের চৌকিদার বসানো হয়। এর মধ্যে গত ৬ এপ্রিল চৌকিদার প্রত্যাহার হওয়ায় কালুরঘাট সেতুতে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করে চিঠি দিয়েছিলেন কালুরঘাট সেতুর পূর্ববর্তী স্টেশন জান আলী হাট স্টেশন মাস্টার।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তাকে (ডিটিও) দেওয়া ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, গত ১ এপ্রিল থেকে কালুরঘাট সেতুর উভয় প্রান্তের কেবিন ঘর থেকে চৌকিদার প্রত্যাহার করা হয়েছে। বর্তমানে এই সেতুতে ‘ডেড স্টপ’ দেওয়া থাকায় চৌকিদার না থাকায় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারগামী ট্রেনগুলো দ্রুতগতিতে সেতু অতিক্রম করছে। এতে যে কোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। এই চিঠির পর রেলওয়ের পক্ষ থেকে পুনরায় সেতুর দুই প্রান্তে চৌকিদার পদায়ন করা হয়।

রেলের ওয়ার্কিং টাইম টেবিল নং-৫৪ অনুযায়ী, চট্টগ্রাম-দোহাজারী সেকশনের মধ্যে জান আলী হাট ও গোমদণ্ডী স্টেশনের মধ্যবর্তী দূরত্ব মাত্র ৫ দশমিক ২৩ কিলোমিটার। ৬০ কিলোমিটার গতিবেগে গোমদণ্ডী থেকে জান আলী হাট স্টেশনে আসতে একটি আন্তঃনগর ট্রেনের সময় লাগবে ৫-৭ মিনিট। গতি নিয়ন্ত্রণাদেশ থাকায় ট্রেনটি গোমদণ্ডী স্টেশন থেকে ছেড়ে আসার কয়েক মিনিটের মধ্যে কালুরঘাট সেতু এলাকায় এসে পৌঁছায়।

ফলে সেতুটি ট্রেন চলাচলের জন্য নিরাপদ ঘোষণা দিয়েই লোকোমাস্টারকে ক্লিয়ারেন্স দেয় গোমদণ্ডী স্টেশন কর্তৃপক্ষ। এর পরও সেতুতে যানবাহন থাকলে দুর্ঘটনা অনিবার্য, যা রেলের অপারেশন বিভাগের বড় দুর্বলতা বলে মনে করছেন রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা।

একাধিক রেলকর্মী বলেন, একটি ট্রেন কক্সবাজার থেকে পটিয়া স্টেশন ছেড়ে আসার পরপরই সেতুর উভয় প্রান্তের স্টেশনগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। ট্রেনটি পটিয়ার পর খানমোহনা, ধলঘাট, ভেঙ্গুরা, গোমদণ্ডী স্টেশন থেকে (যদি যাত্রাবিরতি না থাকে) পিএলসি বা পেপার লাইন ক্লিয়ারেন্স নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

ডেড স্টপে থেমে যাওয়ার নিয়ম থাকলেও কোনো লোকোমাস্টার যদি ভুলক্রমে না থামে, তখন দুর্ঘটনার বড় ঝুঁকি থাকবে। রেলের সেতুতে যানবাহন চলাচল বিরল হওয়ায় রেলওয়েকে কালুরঘাট সেতুর বিষয়ে আধুনিক ট্রাফিক পদ্ধতি চালুর বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মোহাম্মদ সুবক্তগীন বলেন, রেলের জন্য চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতুটি গুরুত্বপূর্ণ। কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ বিস্তৃত হওয়ায় কর্ণফুলী নদীতে নতুন সেতু নির্মাণ পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে। আগামী বছর নির্মাণকাজ শুরু হয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে এটি চালু হবে। এর আগে কালুরঘাট সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল করতে নিরাপত্তাকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে।

কয়েকটি দুর্ঘটনার পর আমরা অনেক সতর্ক হয়ে ট্রেন অপারেশন করতে নির্দেশনা দিয়েছি। তা ছাড়া নতুন প্রকল্পের অধীনে ফৌজদারহাট থেকে দোহাজারী পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হবে। সে পর্যন্ত কক্সবাজারের ট্রেন অপারেশনে অধিক সতর্কতার বিষয়টি মাথায় নিয়ে রেলওয়ে কাজ করছে বলে জানান তিনি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কক্সবাজারে সম্পত্তির দ্বন্দ্বে ভাই-ভাতিজাকে কুপিয়ে জখম

গাজায় আগ্রাসনে নেমে নিহত সাত ইসরায়েলি সেনা

দাম্পত্যের ছয় বছরের সুর থেমে গেল, কণার বিচ্ছেদ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে / অপতথ্য মোকাবেলায় মেটাকে প্রধান উপদেষ্টার আহ্বান

ন্যাটোপ্রধানের চোখে / ইরান-ইসরায়েল দুষ্ট বালক, শাসনে বাবা ট্রাম্প!

জুলাই সনদ নিয়ে ওয়াদা ভঙ্গ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার, বিক্ষোভের ডাক

৯ দিন ধরে রেজিস্ট্রি কার্যক্রম বন্ধ, সাব-রেজিস্ট্রারের পদত্যাগ দাবি

টঙ্গীতে কারখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিএনপির দুগ্রুপের সংঘর্ষ

‘ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরান ঐশ্বরিক বিজয় পেয়েছ’

রংপুর কারমাইকেল কলেজ / একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রেখেই আন্দোলন শিথিল

১০

আল জাজিরার বিশ্লেষণ / ইরানের বিরুদ্ধে যেভাবে ‘ব্যর্থ’ ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র

১১

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান

১২

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘এক্সকিউজ’ দেওয়ার ট্রেনিংপ্রাপ্ত : হাসনাত আব্দুল্লাহ

১৩

চীন সফরে তৃতীয় দিনে ব্যস্ত সময় পার করল বিএনপির প্রতিনিধিদল

১৪

চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেলপথ / লোকাল ট্রেনের ব্যবস্থাপনায় চলছে ৪ আন্তঃনগর ট্রেন

১৫

‘জনগণের কাছে আমাদের সংস্কারের একটা ফুটপ্রিন্ট রেখে যেতে চাই’

১৬

বন্ধুদের সঙ্গে নদীতে গোসলে নেমে স্কুলছাত্র নিখোঁজ

১৭

বিশ্লেষণ / ইসরায়েলের জৈব দুর্গের পতন

১৮

ঢাকা উত্তর সিটির বাজেট ৬ হাজার ৬৯ কোটি টাকা

১৯

ন্যাটো প্রধানের ‘ড্যাডি’ ডাক নিয়ে যা বললেন ট্রাম্প

২০
X