গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেছেন, আর কেউ যাতে বাংলাদেশে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলতে না পারে, আমরা সে কারণে লড়াই করেছি।
সোমবার (২৮ জুলাই) বিকেলে খুলনার শিববাড়ী মোড়ে আয়োজিত জুলাই সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।
জোনায়েদ সাকি বলেন, নির্বাচন দিলে হেরে যাবে, এ ভয়ে তারা পুরো ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে চেয়েছিল। কেন একজন ব্যক্তি চাইলেই ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে পারে? কেউ একজন চাইল আর ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখল বছরের পর বছর। একটার পর একটা তামাশার নির্বাচন করে সে টিকে গেল! এর কারণ, সে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাটাকে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছিল। আমাদের দেশে যতগুলো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আছে- পুলিশ, প্রশাসন, আইন-কানুন, সংবিধান সবকিছু পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছিল। এভাবে পকেটে ঢুকিয়ে, জনগণের ওপর স্টিমরোলার চালিয়ে, ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল তারা। দেশ উজাড় করে দিয়ে বিদেশিদের পায়ে ধরে ক্ষমতা রক্ষা করতে চেয়েছিল তারা। এজন্য আমাদের আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন ঘটাতে হবে, একইসঙ্গে রাষ্ট্রকে যে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলা যায়- সেটা বাতিল করতে হবে। আর কেউ যাতে বাংলাদেশে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলতে না পারে। আমরা সে কারণে লড়াই করেছি। যখন আমরা যুগপৎ লড়াই করেছি, তখনই আমরা এ প্রশ্নটা এনেছিলাম।
তিনি বলেন, এ ব্যবস্থা তারা করতে পেরেছিল। কারণ, আমাদের সংবিধানে ক্ষমতার কোনো ভারসাম্য নেই। ওখানে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ নেই। কেউ কাউকে জবাবদিহি করতে পারে না। সব ক্ষমতা কেবল একজন ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত। যে-ই প্রধানমন্ত্রী হোক, পুরো রাষ্ট্র তার পকেটে। এ রকম ক্ষমতা আছে বলেই তারা আমাদের ওপর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে পেরেছে। সব অধিকার কেড়ে নিয়েছে। শেখ হাসিনা এই ব্যবস্থার চূড়ান্ত নগ্ন চেহারাটা আমাদের সামনে দেখিয়েছে। যার পরিণতিও সে দেখেছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আর কেউ যদি আমাদের দেশের নাগরিকদের অধিকার কেড়ে নিতে চায়, তার পরিণতি শেখ হাসিনার মতো হবে। দেশ ছেড়ে পালাতে হবে।
বিগত ফ্যাসিস্ট শাসনের কথা উল্লেখ করে জোনায়েদ সাকি বলেন, আমাদের দেশের সব জনগণের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসন। আমরা সেটা থেকে মুক্তি পেয়েছি, সেটা আমাদের গণঅভ্যুত্থানের অর্জন। কিন্তু এবারের লড়াইয়ে শুধু এতটুকু অর্জনের জন্যই আমাদের সন্তানরা, আমাদের নাগরিকরা এভাবে আত্মাহুতি দেননি, এভাবে শহীদ হননি। হাজার হাজার তরুণ আহত হয়ে পঙ্গুত্বের চিহ্ন বহন করে চলেছে।
তিনি বলেন, আমরা যদি ব্যবস্থা বদলাতে চাই, তাহলে প্রথমে শুরু করতে হবে ন্যায়বিচার দিয়ে। ১৯৭১ সালের পরেও এ দেশের মানুষ বলেছিল, ৭১-এ যে অপরাধ হয়েছে তার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কিন্তু ঠিকমতো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। আজকে ২৪-এর পরেও আমরা আওয়াজ তুলছি, এই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না করলে আমরা রাষ্ট্রটা যে জায়গায় নিতে চাই সেখানে যাবে না। রাষ্ট্র যদি ন্যায়বিচার ও ইনসাফ কায়েম করতে না পারে তাহলে সেটা জনগণের রাষ্ট্র থাকে না।
জোনায়েদ সাকি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার বিচার শুরু করেছে। এখনো পর্যন্ত শহীদের তালিকাটাই ঠিক হয়নি। শহীদ পরিবার হাহাকার করছে, তাদের দায়িত্ব রাষ্ট্র ঠিকমতো নিতে পারেনি। শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ঠিকমতো দিতে পারেনি। ৫ আগস্ট এসে যাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনার সরকার এক বছরের মধ্যে শহীদের তালিকা তৈরি করতে পারল না, তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে এবং পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারল না, আহতরা এখনো চিকিৎসার জন্য ক্ষোভ ঝাড়ে, তাদের পরিবার কীভাবে চলবে সে দায়িত্ব আপনারা নিতে পারলেন না। কাজের তালিকায় আগে অগ্রাধিকার ঠিক করুন। অভ্যুত্থানের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন, অভ্যুত্থান যা চায়, সেটা দিতে হবে। সে কাজই সম্পন্ন করা আপনাদের দায়িত্ব। আজীবন আপনারা ক্ষমতায় থাকবেন না। প্রতিটি শহীদ পরিবার যাতে এই সন্তুষ্টিতে থাকে যে, অন্তত বিচার শুরু হয়েছে। প্রয়োজনে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ আর ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় ফিরবে না। যে সংস্কার ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করে, জনপ্রতিনিধিদের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য করে- সে সংস্কার অবশ্যই করতে হবে। তিনি আরও বলেন, যদি দেখা যায় যে, ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রয়োজনীয় সংস্কারে ঐকমত্য হচ্ছে না, আমরা জনগণের কাছে যেতে চাই। আপনারাই হচ্ছেন আসল ক্ষমতার মালিক, আপনারাই ঠিক করবেন বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় কোন কোন বিষয় প্রয়োজন। আপনারা নিজেদের ভোট প্রয়োগ করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবেন। সংস্কার বাস্তবায়ন করতে শেষপর্যন্ত জনগণের কাছে যেতে হবে। জনগণকে বাদ দিয়ে সংস্কার হবে না। জনগণকে নিয়ে সংস্কার করতে হলে নির্বাচন দিতে হবে। নির্বাচন ছাড়া জনগণের অংশগ্রহণে সংস্কার কীভাবে হবে? তাই আমরা সংস্কারের রূপরেখা চাই, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ ও নির্বাচনের তারিখ চাই। বিচার, সংস্কার, নির্বাচন- এই রোডম্যাপ থেকে যারা আমাদের অন্যদিকে নিতে চাইবে তারা জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে।
জোনায়েদ সাকি বলেন, লুটপাট ও দুর্নীতি করে আমাদের দেশের গর্ব পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তার জন্য কি শ্রমিকরা দায়ী? সব আমলা আর দুর্নীতিবাজ পরিচালকরা মিলগুলোকে লুটপাট করে ফোকলা বানিয়ে দিয়েছিল। শেখ হাসিনা যেমন রাতের আঁধারে চুরি করে, তেমনি করোনার সময় এ কারখানাগুলো বন্ধ করে দিল। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত আপনারা এখনো বাতিল করতে পারেননি। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে বলেছিলাম, অন্তত একটা মিল ভালো করে চালু করেন, একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যান। যদি শ্রমিক, কৃষকের স্বার্থ না দেখা হয়, যদি শ্রমজীবী, কর্মচারী, নিম্নবিত্ত মানুষের শিক্ষা-স্বাস্থ্য, ন্যূনতম মজুরি, কর্মসংস্থান না হয়- তাহলে সেই গণতন্ত্রে আবারও কতিপয় লোক সব সম্পদ কেন্দ্রীভূত করবে। আর কতিপয়ের হাতে যখন সব সম্পদ থাকে, তখন সেটা স্বৈরতন্ত্র আর ফ্যাসিবাদ হওয়া থেকে আর ঠেকানো যায় না। সম্পদের যদি সুষম ও ন্যায্য বণ্টন না হয়, তাহলে কোনো রাষ্ট্র স্বৈরাচার আর একচেটিয়া কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হতে পারে না।
গণসংহতি আন্দোলন রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য প্রখ্যাত কৃষক নেতা দেওয়ান আব্দুর রশীদ নীলু বলেন, সরকারের তিনটি দায়িত্ব। বিচার, সংস্কার, নির্বাচন। এই তিন দায়িত্ব পালনের কোনো অগ্রগতি আমরা লক্ষ্য করছি না। কিন্তু বিচার এবং সংস্কারকে নির্বাচনের মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে যেন নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়া যায়। এই তিনটি কাজ ঠিকমতো করাই নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। এটা শুধু রাজনৈতিক বন্দোবস্ত না, এটি শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষসহ সারা দেশের সব মানুষের মুক্তির বন্দোবস্ত।
গণসংহতি আন্দোলনের জাতীয় পরিষদের সদস্য মো. অলিয়ার রহমান শেখ বলেন, এ গণঅভ্যুত্থান শুধু বৈষম্যবিরোধী নয়, এই আন্দোলন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, মানুষের ভোটের অধিকার, মৌলিক চাহিদার অধিকার ফিরে পাওয়ার। খুলনার ঐতিহ্য রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করে দিয়েছিল ফ্যাসিস্ট সরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে পাটকল চালু করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
দলের খালিশপুর উপজেলা আহ্বায়ক মোশাররফ হোসেন বলেন, দিনের ভোট যাতে রাতে না হয় সে লক্ষ্যে সংবিধান সংস্কার করতে হবে যেন নতুন করে স্বৈরাচার দানা বাঁধতে না পারে।
এই অভ্যুত্থান বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে রূপান্তর করার সুযোগ এনে দিয়েছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন বরিশাল জেলার সভাপতি সাকিবুল ইসলাম সাফিন বলেন, এ সরকারের কাজ ছিল শহীদ ও আহতদের মর্যাদা প্রদান এবং চিকিৎসা নিশ্চিত করা, বিচার, সংস্কার এবং নির্বাচন করা। কিন্তু সরকার এই এক বছরে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আমরা দ্রুত এই কার্য সম্পাদন দেখতে চাই।
সমাবেশের আগে ‘বন্ধকৃত ২৬টি পাটকল-নিউজপ্রিন্ট-হার্ডবোর্ড মিলসহ খুলনার সব শিল্পকারখানা চালু করতে হবে’ এই দাবি নিয়ে পদযাত্রায় অংশ নেন দলের নেতাকর্মীরা। পদযাত্রাটি খুলনার খালিশপুর থেকে শিববাড়ী পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়।
গণসংহতি আন্দোলন খুলনা জেলার সভাপতি মুনীর চৌধুরী সোহেলের সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন-জেএসডির খুলনা মহানগরের সভাপতি খান লোকমান হাকিম, ভাসানী অনুসারী পরিষদ খুলনা মহানগরের সভাপতি শেখ আবদুল হালিম, গণসংহতি আন্দোলন অভয়নগর উপজেলার সদস্য সচিব সামস সারফিন সামন, খালিশপুর-দৌলতপুর জুটমিল যৌথ কারখানা কমিটির নেতা মনির হোসেন মনি, প্লাটিনাম জুটমিলের শ্রমিকনেতা নূরুল ইসলাম, দৌলতপুর জুটমিল কারখানা কমিটির সভাপতি নূর মোহাম্মদ, হার্ডবোর্ড মিলের শ্রমিক নেতা মো জহিরুল ইসলাম জব্বারসহ বিভিন্ন বন্ধুপ্রতীম সংগঠন ও দলের স্থানীয় নেতারা।
মন্তব্য করুন