অনেক স্বপ্ন নিয়ে বসত গড়েন মেঘনা তীরের মানুষ। সেই বসত ভেঙে নিয়ে যায় সর্বনাশা নদী। হারিয়ে যায় জমিজমা, ছেলে-মেয়ে, সংসার। নদীর চরে চরে তারা খুঁজে বেড়ান বেঁচে থাকার নতুন স্বপ্ন। এমনই জীবন মেঘনা উপকূলের মানুষের।
একবার ভাঙে বসতভিটা। আবার গড়েন, ফের ভাঙে। এভাবেই জীবনের নিয়মে আবার নতুন করে অন্যত্র বাঁধেন ঘর। আবারও মেঘনার তীর ভাঙে। বাপ-দাদার বসতভিটা হারিয়ে যেতে যেতে কোথায় গিয়ে বসত গড়েন জানেন না নিজেরাও। এভাবেই চলতে থাকে ভাঙনকবলিত মানুষের জীবন।
এমনই এক ভাগ্যহত ভাঙনকবলিত জীবন আলাউদ্দিনের। এ পর্যন্ত ৯ বার তিনি মেঘনার ভাঙনের শিকার হয়েছেন। ষাটোর্ধ্ব আলাউদ্দিন এখন ঘর বেঁধেছেন লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চররমিজ ইউনিয়নের চরগোঁসাই গ্রামে। সেখানে স্ত্রী, তিন মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন।
একসময় চরআলগী গ্রামে থাকতেন আলাউদ্দিন। ভাঙনে পড়ে একরকম ভাসতে ভাসতে এখন খুঁটি গেঁড়েছেন চরগোঁসাই গ্রামে।
একসময় জমিজমা থাকলেও এখন আলাউদ্দিনের জমিজিরাত না থাকায় অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করেন। সেই কাজ না পেলে ওঠেন নৌকায়। মাছধরা শ্রমিক হিসেবে যা আয় হয়, তা দিয়েই পরিবারের ভরণপোষণ করতে হয়।
চরগোঁসাই গ্রামের যেখানে এখন আলাউদ্দিনের বসতি, সেখান থেকে মেঘনার দূরত্ব ৫০ গজের মতো। পাশে বেড়িবাঁধ না থাকায় প্রতিদিন জোয়ারে তার ঘরে ওঠে কোমরসমান পানি। ফলে রান্নাবান্না করাও কঠিন হয়ে পড়ে। যে কোনো সময় আবার মেঘনার ভাঙনের শিকার হতে হবে তাকে। আলাউদ্দিনের মতো হাজারো মানুষ গত কয়েক বছরে বসতভিটা, ফসলি জমি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন।
জানা গেছে, গত ৭ বছরে রামগতি উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের অন্তত সাত কিলোমিটার মেঘনায় বিলীন হয়েছে। চলতি বর্ষায় প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। পাশাপাশি চলছে ভাঙন। স্থানীয়দের আশঙ্কা, দ্রুত সময়ের মধ্যে বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হলে উপজেলার মানচিত্র থেকে মুছে যেতে পারে বেশ কয়েকটি গ্রাম। এসব এলাকার বাসিন্দাদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালে মেঘনা তীরে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে প্রকল্প নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রকল্পের আওতায় রামগতির বড়খেরী থেকে উত্তরে কমলগরের মতিরহাট পর্যন্ত ৩১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ হওয়ার কথা। এর মধ্যে রামগতিতে ১৮ কিলোমিটার ও কমলনগরে ১৩ কিলোমিটার পড়েছে।
জিও ব্যাগ, ব্লক ফেলা ও মাটি ভরাটসহ ১০২টি প্যাকেজে কাজের ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। চলতি বছরের ডিসেম্বরে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। অথচ, এখনো সিকিভাগ কাজও দৃশ্যমান হয়নি। এ পর্যন্ত অর্থছাড় হয়েছে মাত্র ৮০০ কোটি টাকা।
স্থানীয় বাসিন্দারা এ কাজে পাউবো ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তোলেন। তারা জানিয়েছেন, নানা ছুঁতো দেখিয়ে ধীরগতিতে চলছে কাজ।
চররমিজ ইউনিয়নের বিবিরহাট বাজারের ব্যবসায়ী শাকিল রানা (২৯) বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই প্রকল্পটির কোনো অগ্রগতি নেই। ঠিকাদারের কোনো খোঁজ নেই। এমনকি কোনো প্রতিনিধিও নেই।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পাউবোর কার্যাদেশ পেলেও ঠিকাদাররা বালু ও শ্রমিক সংকটের অজুহাত দেখিয়ে যথাসময়ে কাজ শুরু করেননি। কিছু অংশে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হলেও অন্য কাজ কিছুই হয়নি। ফলে প্রতিনিয়ত জোয়ারের পানিতে নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যায়। বড়খেরী ইউনিয়নে দৃশ্যমান তেমন কোনো কাজই হয়নি। ফলে নদীভাঙনের মুখে রামগতি-লক্ষ্মীপুর আঞ্চলিক সড়কের বড়খেরীর অংশ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
বড়খেরী ইউনিয়নের রঘুনাথপুরের বাসিন্দা তানসেন দাস (৩৫) বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি অভিযোগ করেন, ওই এলাকায় ঠিকাদার বালু ও শ্রমিক সংকটের কথা বলে কাজ শুরু করেননি। যে কারণে পুরো এলাকাই ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পড়েছে। কয়েকটি বাড়ি নদীতে চলে গেছে। শুকনো মৌসুমেও কাজ না করে নানা অজুহাত দেখায় ঠিকাদারের লোকজন। এখন চলছে বর্ষার অজুহাত।
বড়খেরী ইউপির প্যানেল চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমানের ভাষ্য, সময়মতো কাজ না করায় এ ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট বিলীন হওয়ার পথে। দ্রুত বাঁধের কাজ শুরু না হলে পুরো ইউনিয়নই হারিয়ে যেতে পারে।
সামাজিক সংগঠন কমলনগর-রামগতি বাঁচাও মঞ্চের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার পালোয়ান বলেন, বালু সংকটের অজুহাত দেখিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক কাজ হয়নি। গত পাঁচ বছরে প্রকল্পটিতে প্রতি অর্থবছরে গড়ে ৬০০ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে সেই বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। কাজের শুরু থেকেই স্থানীয় লোকজন সেনাবাহিনীর মাধ্যমে কাজটি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আসছিলেন; কিন্তু তা হয়নি। প্রকল্পের প্রতিটি লটের কাজে সমান্তরাল অগ্রগতি নেই। কোথাও জিও ব্যাগের ডাম্পিং হচ্ছে, আবার কোথাও ব্লক ডাম্পিং হচ্ছে। আবার কোথাও এখনো কাজ শুরুই হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তিনজন প্রকৌশলী জানিয়েছেন, প্রকল্পের কার্যাদেশপ্রাপ্ত ৯৭টি লটের মধ্যে ৩৫টি লটে কোনো কাজ হচ্ছে না। এর মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসএসইসিএলের সাতটি লটে দু-তিন ভাগ, এডব্লিউআরের পাঁচটি লটে দুই ভাগ, বিশ্বাস বিল্ডার্সের ছয়টি লটে দুই ভাগ, ইলেকট্রো গ্রুপের একটি লটে পাঁচ ভাগ শেষ হওয়ার পর প্রকল্পের কাজ বন্ধ। অন্যদিকে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ১৫টি লটে প্রায় ৪০ ভাগ শেষ হওয়ার পর থেকে কাজ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তা বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
রামগতির ইউএনও সৈয়দ আমজাদ হোসেন বলেন, বাস্তবিক অর্থে নদীর বাঁধের কাজ বিষয়ক সম্পূর্ণ দায়িত্বশীল সংস্থা হচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কাজের অগ্রগতি কিংবা সমস্যা বিষয়ক যে কোনো ভূমিকা তাদেরই। এক্ষেত্রে আমার কিছুই করার এখতিয়ার নেই। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝেছি তারা বাঁধ এর কাজ বিষয়ে খুবই আন্তরিক। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।
তবে কাজ দৃশ্যমান না হওয়ার তথ্য অস্বীকার করেন লক্ষ্মীপুর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান। তার দাবি, এরই মধ্যে অনেক স্থানে বাঁধ দৃশ্যমান। ফলে ভাঙন এখন কোথাও নেই। বছরে কাজের জন্য মাত্র কয়েক মাস সময় পাওয়া যায়। এ কারণে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে।
মন্তব্য করুন