যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে চলছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংকট। খাতা-কলমে আছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক; তারা নামমাত্র অফিস সময়ে ওয়ার্ডে দ্রুত রাউন্ডে গিয়ে রোগীর সঙ্গে কথা না বলে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন। অফিস সময়ের পর থেকে অফিস শুরুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত চিকিৎসা কার্যক্রম চালান আয়া, ওয়ার্ডবয় ও ঝাড়ুদার। অফিস সময়ে বিশেষজ্ঞদের চিকিৎসা মোবাইল ফোনে নিয়ে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা।
রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, ক্লিনিক বাণিজ্য জমজমাট করার জন্য চিকিৎসকরা সরকারি হাসপাতালে দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেন। এ কারণে সরকারি হাসপাতালে রোগীরা উন্নত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। রাতে চিকিৎসকের অনুপস্থিতিতে কাটা-ছেঁড়া রোগী দেখলেই এগিয়ে আসেন ওয়ার্ডবয়, আয়া অথবা ঝাড়ুদার। তারা রোগীর স্বজনদের হাতে চিকিৎসা সামগ্রী কেনার শর্ট স্লিপ ধরিয়ে দেন। এরপর ইনজেকশন, সিরিঞ্জ, স্যালাইন, সুঁই-সুতো নিয়ে তারাই করেন চিকিৎসা। আবার ক্যানোলা, ইউরিন ব্যাগ, খাদ্য গ্রহণের নল (পাইপ) লাগানোর কাজও করেন তারা।
হাসপাতালের প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, এই হাসপাতাল এই অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের ভরসার স্থল। যে কারণে যশোর ছাড়াও নড়াইল, মাগুরা ও ঝিনাইদহ জেলার রোগীরা এই হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য আসেন। এই রোগীদের ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার জন্য ৫৭ জন চিকিৎসকের বিপরীতে আছেন ১০৪ জন চিকিৎসক, মেডিকেল কলেজের ৮৮ জন চিকিৎসক এবং ইন্টার্ন চিকিৎসক। তাই রোগীরা উন্নত চিকিৎসার আশা নিয়ে ভর্তি হন এ প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু ভর্তির পর থেকে তারা চিকিৎসা দুর্ভোগের শিকার হন। বিভিন্ন রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন কিন্তু রোগীদের ভাগ্যে ঠিকমতো তাদের চিকিৎসাসেবা জোটে না। প্রতিদিন সকালে সব বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নামমাত্র একবার করে ওয়ার্ড রাউন্ডে যান। তাও তড়িঘড়ি করে রাউন্ড শেষ করেন। যে কারণে অনেক রোগী তাদের রোগ নিয়ে ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না। তাদের অনিয়মের কারণে রোগীরা সরকারি হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে অনেকেই সরকারি হাসপাতাল ছেড়ে ক্লিনিকে চলে যেতে বাধ্য হন। এতে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য আরও বেড়ে যায়।
রফিকুল ইসলাম নামে রোগীর এক স্বজন জানান, সকালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা দলবেঁধে রাউন্ডে আসেন। কিন্তু বেশি সময় রোগীর সঙ্গে কথা বলেন না। ব্যস্ততার সঙ্গে বের হয়ে যান। সারাদিনে বিশেষজ্ঞদের আর দেখা মেলে না। এছাড়াও তারা রাতে ওয়ার্ড রাউন্ডে আসেন না।
তিনি আরও জানান, পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে তার রোগী এক সপ্তাহের বেশি চিকিৎসাধীন। এত দিনে একরাতেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগীর ফলোআপ চিকিৎসার জন্য রাউন্ডে যাননি। রফিকুলের মতো একই কথা জানান রোগীর স্বজন রাসেল, বৃষ্টি, পারভীনা ও আশাদুল ইসলামসহ অনেকেই।
গত কয়েক দিনে দীর্ঘ সময় পুরুষ সার্জারি ওয়ার্ডে অবস্থান করে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত, ছুরিকাহত, প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হয়ে অনেক রোগী ভর্তি হচ্ছেন। সব রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছেন ইন্টার্ন। রোগীর শারীরিক অবস্থা খারাপ হলেও সহকারী রেজিস্ট্রার ও বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক আসেন না। ইন্টার্ন রোগীর অবস্থা বুঝে চিকিৎসা দেন। অন্যথায় নিয়মবহির্ভূতভাবে রোগীকে অন্যত্র রেফার্ড করে দিচ্ছেন। এই ওয়ার্ড থেকে গত ১ সপ্তাহে ২২ রোগীকে খুলনা অথবা ঢাকায় রেফার্ড করা হয়েছে।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রেফার্ড করা হয় যশোর শহরতলীর ঝুমঝুমপুর এলাকায় ছুরিকাহত সাকিবকে (১৯)। অথচ সরকারি এই হাসপাতালে সার্জারি ও অর্থোপেডিক বিভাগে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ডিগ্রিধারী চিকিৎসক রয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জ্যেষ্ঠ সেবিকা জানান, নিয়ম অনুযায়ী রোগী ভর্তির পর একজন রেজিস্ট্রারের নেতৃত্বে বিভাগ ওয়ারি ইন্টার্ন টিম আসবেন। তিনি রোগীর অবস্থা দেখে অনকলে সহকারী বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে জানাবেন। তিনি রোগী দেখে অবস্থা খারাপ মনে করলে রোস্টার অনুযায়ী দায়িত্বে থাকা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে ডাকবেন। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী কোনো কাজ হয় না এ হাসপাতালে। তাদের অনুপস্থিতিতে সব কাজ করেন ইন্টার্ন চিকিৎসক।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এখানেই রয়েছে অনিয়মের বিশাল এক বাণিজ্য। বিশেষজ্ঞরা ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চেম্বারে পকেট ভরতে ব্যস্ত থাকেন। আর সব কিছু ছেড়ে দেওয়া হয় ইন্টার্নদের ওপর। ইন্টার্নদের অনকলে না এসে; সেটা অন মোবাইলে কনভার্ট হয়েছে। অনেক সময় ইন্টার্নরা মোবাইলে রোগীর পরিস্থিতি জানানোর পর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মোবাইলেই রোগীর জন্য চিকিৎসার সাজেশন দেন। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ফাইলে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের হাতের লেখায় এমন অসংখ্য নজির রয়েছে। এজন্য ইন্টার্নরা ‘দিনভিত্তিক সম্মানি’ও পেয়ে থাকেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালের কাটা ছেড়া রোগী আসলেই এগিয়ে আসেন ওয়ার্ডবয়, আয়া অথবা ঝাড়ুদার। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সহকারী রেজিস্ট্রারদের অনুপস্থিতিতে তারা রোগীর স্বজনদের হাতে চিকিৎসা সামগ্রী কেনার শর্ট স্লিপ ধরিয়ে দেন। এরপর ইনজেকশন, সিরিঞ্জ, স্যালাইন, সুই সুতো রোগীর স্বজনরা আনলে তারা সেই মালামাল রেখে বাইরে বিক্রি করেন। আর হাসপাতালের সরবরাহকৃত জিনিস দিয়ে রোগীদের চিকিৎসা করেন। আবার ক্যানোলা, ইউরিন ব্যাগ, খাদ্য গ্রহণের পাইপ লাগানোর কাজও তারা করেন। এতে তারা লাভবান হন। কেননা প্রতি রোগীর স্বজনদের জিম্মি করে হাসপাতালের কর্মীরা অর্থ বাণিজ্য করেন। সার্জারি, মেডিসিন, গাইনি ওয়ার্ডে অধিকাংশ সময় চিকিৎসকের ভূমিকায় ওয়ার্ডবয় ও ঝাড়ুদারকে দেখা যায়।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার মদনপুর গ্রামের ঠান্ডু মিয়ার স্ত্রী তাহমিনা খাতুন (৪৫) সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এ হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসকের অনুপস্থিতিতে ওয়ার্ডে দায়িত্বরত আয়া রোগীর ক্ষত স্থানে সেলাই দেওয়াসহ চিকিৎসা দেন।
একাধিক রোগীর স্বজন জানিয়েছেন, জরুরি বিভাগ থেকে চিকিৎসা ছাড়া সারাদিনে কোনো চিকিৎসক রোগীর কাছে যান না। সরকারি এই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নেই বললেই চলে। জরুরি মুহূর্তে রোগীর চিকিৎসাসেবায় ডাক্তার পাওয়া যায় না। কিছু কিছু সময় সিনিয়র সেবিকারাও রোগীর কাছে যান না। একবারের বেশি ডাকলে তারা খুব রূঢ় আচরণ করেন। তারাও শিক্ষানবিশ সেবিকাদের দিয়ে কাজ সারেন। সরকারি জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক-সেবিকা যেন ফাঁকিবাজিতে ব্যস্ত।
এ বিষয়ে যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার হুসাইন শাফায়াত কালবেলাকে জানান, দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সহকারী রেজিস্ট্রারসহ সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরপরও কেউ রাতে ওয়ার্ড রাউন্ডে আসেন না বলে জানতে পেরেছেন। তাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন