

শস্য ও মৎস্যভান্ডার খ্যাত পাবনা বেড়ার খালবিলে অবাধে চলছে শামুক নিধন। অপরিকল্পিতভাবে শামুক নিধনের ফলে বিলের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ার পাশাপাশি ফসলি জমির উর্বরতাও হ্রাসের শঙ্কা করছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ। সরকারি নিয়মে শামুক সংগ্রহ, ধ্বংস, ভক্ষণ, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, আমদানি-রপ্তানি করা ইত্যাদি দণ্ডনীয় অপরাধ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্ষা মৌসুমের মাঝামাঝি সময় থেকে পানি নেমে যাওয়া পর্যন্ত বেড়ায় শামুক শিকার হয়। বেড়া উপজেলার জোরদহ বিল, কাজলকুড়া, ধলাই, ট্যাংরাগাড়ি, বক্কারের বিলসহ দুই উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার মন শামুক শিকার করা হচ্ছে। আর এসব শামুক গ্রাম অঞ্চলের হাঁস ও মাছের খামারে সরবারহ ছাড়াও পাইকারদের মাধ্যমে খুলনা ও বাগেরহাটে বিক্রি করা হচ্ছে।
বিগত তিন চার বছরের ব্যবধানে একেবারে কমে গেছে শামুকের সংখ্যা। অনেকেই না জেনে বাড়তি আয়ের জন্য প্রতিদিনিই নৌকা নিয়ে বের হন শামুক শিকারে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মই জাল, হেসি জাল ও হাত দিয়ে শামুক সংগ্রহ করে নৌকায় ভর্তি করেন তারা। পরে সেসব শামুক পাইকারদের নিকট ৫ থেকে ৭ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বেড়া উপজেলার নতুন ভরেঙ্গো গ্রামে গ্রামের বিভিন্ন বিল থেকে মহিলা ও পুরুষেরা শামুক কুড়িয়ে নৌকায় করে এনে বিক্রি করছে প্রতি কেজি ৫-৭ টাকা দরে। আর পাইকারি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন হাঁস ও মাছের খামারিদের কাছে প্রতি কেজি ৮ থেকে ১০ টাকা দরে বিক্রি করেন। এখানে প্রতিদিনি প্রায় পনের শত থেকে দুই হাজার কেজি শামুক ক্রয় করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায় উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এর থেকেও বেশি ক্রয়-বিক্রয় হয়। ভারেঙ্গা গ্রামের শামুক শিকারি জয়নাল জানান, বর্ষা মৌসুমে হাতে তেমন কোনো কাজকর্ম থাকে না। তাই মই জাল ও হেসি জাল দিয়ে শামুক সংগ্রহ করেন তারা। পানি কম হলে হাত দিয়েও শামুক ধরা যায়। ব্যাপারীদের কাছে ৫-৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন।
তারাপুর গ্রামের শামুক শিকারি আলেয়া বেগম বলেন, আমরা গরিব মানুষ। সংসারের কাম কইরা আমার ছোট মেয়েকে নিয়ে বাড়ির কাছের বিল থেকে নৌকা নিয়ে শামুক কুড়াই। প্রতিদিন ৭০-৮০ কেজি শামুক কুড়াই। এতে সাড়ে তিনশ থেকে চারশ টাকা হয়।
বকচর গ্রামের ব্যবসায়ী আজিত জানান, বর্ষাকালে আমাদের এলাকায় প্রচুর শামুক পাওয়া যায়। বিলপাড়ের মানুষেরাই বিভিন্ন আকারের শামুক সংগ্রহ করেন। এসব শামুক আমরা কিনে বস্তায় করে খুলনায় বিক্রি করি। আমাদের এখান থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ বস্তা শামুক বিক্রি হয়। তবে বেড়ার অন্যান্য জায়গায় আরও বেশি শামুক কেনেন ব্যাপারীরা। শামুক ক্রয়-বিক্রয় যে দণ্ডনীয় অপরাধ এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানান তিনি।
এদিকে অপরিকল্পিতভাবে এসব খাল-বিলের জীববৈচিত্র্যের অন্যতম অনুষঙ্গ নিধনের ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য হারানোর শঙ্কা করছেন অনেকেই। হুমকির মুখে পড়বে প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সেই সঙ্গে ফসলি জমির উর্বরতাও হ্রাস পেতে পারে বলে মনে করছে কৃষি বিভাগ।
বেড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিন বলেন, শামুক পানিকে ফিল্টার করে। এগুলো বড় মাছেরও খাদ্য। জলের মধ্যে শামুকের যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি অতিরিক্ত হলে সেগুলো নিধন করাও যেতে পারে। তবে যদি কোথাও অতিরিক্ত শামুক থেকেও থাকে, তা জরিপ করে সেভাবেই আহরণ করা দরকার।
রাজশাহী বিভাগীয় বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ, বন্যপ্রাণী পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর কবীর বলেন, শামুককে বলা হয় প্রাকৃতিক জলশোধন ব্যবস্থা (ফিল্টার)। শামুক ময়লাযুক্ত পানি পান করে জীবনধারণ করে, ফলে পানি পরিষ্কার থাকে। পানিতে শামুক না থাকলে পানির প্রাকৃতিক শোধন ক্ষমতা হ্রাস পায়। বাংলাদেশ সরকারের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুযায়ী শামুক সংগ্রহ, ধ্বংস, ভক্ষণ, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, আমদানি-রপ্তানি করা ইত্যাদি দণ্ডনীয় অপরাধ। সর্বোচ্চ শাস্তি ২ বছর কারাদণ্ড এবং ১ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা। তবে এ বিষয়ে জনসচেতনতা অতি জরুরি।
মন্তব্য করুন