

বয়স ৪০ পেরোলেই পুরুষদের শরীরে নীরবে নানা জটিলতা বাসা বাঁধতে শুরু করে। কর্মব্যস্ত জীবন, দীর্ঘ সময় বসে কাজ করা, মানসিক চাপ, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের অভাব—সব মিলিয়ে পুরুষদের স্বাস্থ্যঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। শুধু ব্যক্তিগত নয়, এর প্রভাব পড়ছে পরিবার ও সামাজিক জীবনেও। তাই এ বয়সের পর নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও সচেতনতা এখন সময়ের দাবি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অসংক্রামক রোগ (এনসিডি), হৃদ্রোগ, ক্যানসার ও প্রজননজনিত সমস্যার ঝুঁকি ৪০-এর পর উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। তবে আগেভাগে সঠিক পরীক্ষা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে এসব ঝুঁকি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
অসংক্রামক রোগ
পুরুষদের মধ্যে রক্তে চর্বি (লিপিড) ও রক্তে শর্করার মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, টাইপ-২ ডায়াবেটিসের সঙ্গে পেটের ভেতরের অতিরিক্ত চর্বি (ভিসেরাল ফ্যাট) জমার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। এর ফলে প্রতি ছয়জন পুরুষের একজনের শরীরে টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা কমে যাচ্ছে, যা ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে।
রেডক্লিফ ল্যাবসের ২ লাখের বেশি নমুনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, যাদের লিপিড প্রোফাইল অস্বাভাবিক, তাদের মধ্যে ৬৩ শতাংশই পুরুষ। একইভাবে লিপিড ও রক্তে শর্করা—দুটোই অস্বাভাবিক এমন ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ পুরুষ। এ তথ্য পুরুষদের জন্য বাড়তি সতর্কতার বার্তা দিচ্ছে।
হৃদ্রোগ
উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও বসে বসে জীবনযাপন—এই চারটি কারণ একসঙ্গে পুরুষদের করোনারি হৃদ্রোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, নিয়মিত হাঁটা বা ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্তচাপ ও রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখলে হৃদ্রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
ক্যানসার
বিশ্বজুড়ে পুরুষদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ ক্যানসার। ভারতের প্রেক্ষাপটে ফুসফুস ও প্রোস্টেট ক্যানসার পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যাচ্ছে। ধূমপান পরিহার, নিয়মিত প্রোস্টেট পরীক্ষা, প্রয়োজন অনুযায়ী ফুল বডি স্ক্রিনিং এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
প্রজনন ও যৌন স্বাস্থ্য
প্রজনন সমস্যায় শুধু নারীরাই নয়, পুরুষরাও সমানভাবে ভুগছেন। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, হরমোনের পরিবর্তন, অতিরিক্ত মদ্যপান ও ধূমপান এবং টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমে যাওয়াই এর প্রধান কারণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস প্রজননস্বাস্থ্য রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ইরেকটাইল ডিসফাংশন (যৌন দুর্বলতা), যা একসময় বয়সজনিত সমস্যা হিসেবে ধরা হতো, এখন তুলনামূলক কম বয়সী পুরুষদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। এটি প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে বাড়তি মনোযোগের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছে।
কেন জরুরি প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা
স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিকল্প নেই। ডায়াবেটিস, লিপিড প্রোফাইল, প্রোস্টেট পরীক্ষা, হৃদ্যন্ত্রের বিভিন্ন পরীক্ষা—এসব নিয়মিত করালে রোগ আগেভাগে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। ফলে সময়মতো চিকিৎসা শুরু করে জটিলতা এড়ানো যায়।
বিশ্ব পুরুষ দিবস উপলক্ষে রেডক্লিফ ল্যাবসের মেডিকেল ল্যাবরেটরি ডিরেক্টর ডা. সোহিনী সেনগুপ্ত বলেন, ‘শুধু অসুস্থ হলে চিকিৎসা নয়, বরং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে সামগ্রিক সুস্থতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। পুরুষদের স্বাস্থ্য নিয়ে সামাজিক সংকোচ ভেঙে খোলামেলা আলোচনা প্রয়োজন। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে এমন অনেক পরীক্ষা রয়েছে, যা ঝুঁকি আগেভাগেই শনাক্ত করতে পারে। সময়মতো পদক্ষেপই সুস্থ জীবনের মূল চাবিকাঠি।’
সুস্থ জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান
ভারতসহ উপমহাদেশে অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বয়স নির্বিশেষে বাড়ছে। সুস্থ থাকতে হলে এখনই স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে—নিজের জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও।
বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্যই আসল সম্পদ। নিজের স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিন, নিয়মিত পরীক্ষা করুন, সচেতন জীবনযাপন করুন—কারণ সুস্থ জীবনই পারে পরিবার ও সমাজকে এগিয়ে নিতে।
সূত্র : দ্য হেলথ সাইট
মন্তব্য করুন