রাজধানীর উপকণ্ঠে ও ডেমরা-রূপগঞ্জের কোল ঘেঁষা বালু নদ। এ নদের পঁচা পানি নদী পাড়ের লাখো মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। শুধু মানুষের জীবন তা কিন্তু নয়। কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের বিপর্যয় ঘটেছে। গত প্রায় আড়াই যুগ ধরে লাখো মানুষ পঁচা পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে আসছে। আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু আড়াই যুগেও এ এলাকার মানুষদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। পঁচা পানির কারণে নদে এখন মাছ নেই। বেড়েছে মশার উপদ্রব। কমে গেছে ফসলের উৎপাদন। বেড়েছে রোগবালাই। দূষিত পানির কটু গন্ধে তীরবর্তী এলাকার মানুষের দুর্ভোগও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে প্রাণ-পরিবেশ। বিপর্যস্ত মানুষের জীবন।
রাজধানী ঢাকার পয়োবর্জ্য ও শিল্প কারখানার বর্জ্য পড়ে এ নদের পানি এখন আলকাতরার মতো কালো হয়ে গেছে। তাই স্থানীয়রা একে ‘পঁচা’ পানি বলে। রাজধানী ঢাকার নাসিরাবাদ, ডেমরা, বেড়াইদ, ত্রিমহোনীসহ প্রতিবেশী রূপগঞ্জের ৫০ গ্রামের লাখো মানুষের কাছে বালু নদের পঁচা পানি এখন অভিশাপ।
যেভাবে দূষণ বালু নদী
শীতলক্ষ্যার মোহনা ডেমরা সুলতানা কামাল সেতু থেকে শুরু করে টঙ্গীতে গিয়ে তুরাগ নদীতে মিলেছে বালু নদ। বালু নদের দুটো ছোট শাখা নদ নড়াই ও দেবধোলাই ঢুকেছে ঢাকার রামপুরায়। এ ছোট শাখা দুটো দিয়ে ঢাকার মিরপুর, পল্লবী, উত্তরা, গুলশান, তেঁজগাও, সবুজবাগ, মতিঝিলসহ বিশাল এলাকার শিল্প ও পয়োনালার বর্জ্য এসে রামপুরা ব্রিজের নিচ দিয়ে বালু নদে পড়ছে। বছরের পর বছর আবর্জনা পড়তে পড়তে এর পানি এখন বর্জ্য হয়ে পড়েছে।
ঢাকা ওয়াসার একটি সূত্র জানায়, বালু নদের মোট দৈর্ঘ্য ২২ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে দৈনিক ১০ লাখ ঘনমিটার পয়োবর্জ্য, ৫৬ কোটি ঘন মিটার বর্জ্য মেশানো পানি, বিভিন্ন কলকারখানার ৪৫০ ঘনফুট বর্জ্য প্রতিদিন এ নদে পড়ছে। এ ছাড়া বালু, নড়াই ও দেবধোলাইয়ের উপড় রয়েছে সহস্রাধিক খোলা পায়খানা। এসব থেকে আরও ৫৬০ ঘনফুট পয়োবর্জ্য নদের পানিতে মিশছে। সবমিলিয়ে বালু নদের পানি এখন ব্যাবহারের অনুপোযোগী হয়ে আলকাতরার রূপ ধারণ করেছে।
পঁচা পানিতে চলে জীবন-জীবিকা
সরেজমিনে বালু নদের তীরবর্তী বালুরপাড়, দাসেরকান্দি, কামশাইর, চানখালী, ধীৎপুর, পশ্চিমগাঁও, চনপাড়া, দক্ষিণপাড়া, নয়ামাটিসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বালু নদের পঁচা পানি অভিশাপ হলেও এসব গ্রামের বৌ-ঝিয়েরা পঁচা পানিতেই থালা-বাসন পরিষ্কার করছে। পুরুষরা এ পানিতেই গরু ছগল গোসল করাচ্ছে। এমনকি লোকজন এ পঁচা পানিতেই গোসল করছে। এ কারণে নদীর তীরবর্তী এলাকার মানুষে খুজলি-পাচড়াসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ বালাই লেগেই আছে।
কেওঢালা এলাকার গৃহবধূ জোসনা আক্তার বলেন, ভাইগো আমরা গরীব মানুষ। এই পঁচা পানিত আমাগো কামকাজ করোন লাগে। জানি ক্ষতি অয়, কি আর করম, আমরা ভালাপানি পামু কই।
পঁচা পানির কারণে বিপর্যস্ত কৃষি
এলাকাগুলো ঘুরে দেখা যায়, নদের পূর্বপাড়ে রূপগঞ্জ আর পশ্চিমপাড়ে ঢাকার খিলগাও, ডেমরা, বেরাইদ, ডুমনী ও নাসিরাবাদ ইউনিয়ন। নদের উভয় তীরজুড়ে ফসলের ক্ষেত। এক সময় এসব জমিতে অধিক ফসল ফলতো। বালু নদীর পঁচা পানির কারণে এখন এর অর্ধেক পরিমাণেও ফসল উৎপাদন হয়না বলে জানালেন অনেক কৃষক। কথা হয় বর্গাচাষি রহম আলীর সঙ্গে।
তিনি বলেন, আগে বিঘায় ধান পাইতাম ৪০ মণ। অহন ১৭ কি ১৮ মণ। কৃষকরা জানায়, বিকল্প উৎস না থাকায় জমিতে তারা বালু নদের পঁচা পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে।
থানা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, পানিতে প্রচুর কার্বন-ডাই অক্সাইড থাকার ফলে চারাগাছের গোড়া পচে যায়। ফলে ফসল উৎপাদন কম হয়। পঁচা পানি রোধ করা না গেলে একসময় এসব এলাকায় কৃষিতে বিপর্যয় নেমে আসবে।
মশা-মাছির যন্ত্রণা
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিবেশ বিপর্যয় ও কৃষি বিপর্যয়ের পাশাপাশি মশা-মাছির যন্ত্রণাও রয়েছে। পঁচা পানির কারণে মশার উপদ্রব এসব এলাকায় অনেক বেশি। দিনের বেলায়ও মশারী খাটিয়ে নিস্তার নেই তাদের। মশা নিধনে নেই সরকারি কোনো উদ্যোগ।
নয়ামাটি এলাকার ইকবাল হোসেন বলেন, পঁচা পানি মানুষের জীবনটা শেষ কইরা ফালাইতাছে। গত ১৮ বছর ধইরা মানুষ ভোগান্তির শিকার অইতাছে। অন্তত মশা থেকে যদি আমাগো বাঁচাইতো তাহলেও শান্তি পাইতাম।
জেলে পল্লীর দুর্দিন
সরেজমিনে বালু নদের তীরবর্তী দাসেরকান্দি, চরচনপাড়া ও ফকিরখালির জেলে পল্লী ঘুরে জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পঁচা পানির কারণে নদে মাছ না থাকায় দেড় শতাধিক জেলে পরিবার এখন নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছে। বছরের ছয় মাস তাদের কাটাতে হয় অর্ধহারে-অনাহারে। তাই তাদের পরবর্তী প্রজন্ম পেশা বদলাচ্ছে। পঁচা পানি তাদের জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে।
দাসেরকান্দি জেলে পল্লীর ষাটোর্ধ্ব নিত্যানন্দ চন্দ্র দাস বলেন, পচা পানি আমগো শেষ কইরা দিছে বাজান। গাঙো মাছ কইত্তে থাকবো কন। পানি তো বিষ অইয়া গেছেগা। মেছের (ম্যাচ) কাঠি ধরাইয়া পানিত ফালাইলে আগুন ধইরা যায়গা।
উপজেলা মৎস্য অফিসার মোহাম্মদ আক্কাস আলী বলেন, নদের পানিতে কার্বন-ডাই অক্সসাইড ও মনো অক্সাইডের পরিমাণ অনেক বেশি। কোনো জীব বা প্রাণী এ অবস্থায় বাঁচতে পারে না।
আন্দোলন-সংগ্রামও ফিকে
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, বালু নদের দূষণ রোধ করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এলাকাবাসী দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাসের বাক্সে বন্দি রয়ে আছে। পঁচা পানি রোধের দাবি জানিয়ে ২০০১ সালের ১১ মার্চ ও ২০০২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ত্রিমোহনীতে দুবার মহাসমাবেশ হয়েছিল। এ ছাড়া রূপগঞ্জের নগরপাড়া এলাকায় বেশ কয়েকবার মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।
ডেমরার এলাকার পরিবেশকর্মী মাহাবুব রহমান ভূইয়া বলেন, ঢাকাকে যেমন বাঁচানো জরুরি, ঠিক তেমনি ৫০ গ্রামের লাখো মানুষকে বাঁচানোটা জরুরি। পঁচা পানির কারণে শুধু মানুষই নয়, পরিবেশ ও কৃষি এমনকি জীববৈচিত্র্যের বিপর্যয় ঘটছে। জরুরি পঁচা পানি রোধ করা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে ঢাকা জেলার তেজগা থানা কৃষি অফিসার আবিদা মানসুরা বলেন, বালু নদীর পানিতে যে বর্জ্য বহন করে সেখানে অতিমাত্রায় ভারী ধাতু থাকার কারণে সকল ধরনের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওযার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তা ছাড়া পরিমাণ মতো ইউরিয়া থাকলে সেটা ফসলের জন্য ভালো, কিন্তু পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত ইউরিয়া ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে থাকে।
মন্তব্য করুন