মানত পূরণ করতে এখনও অসংখ্য মানুষ খোদার পাথর ভিটায় দুধ ঢালেন। তাদের ধারণা, এখানে কোনো কিছু চেয়ে দুধ ঢাললে তা পূরণ হয়। এমন বিশ্বাস থেকে দুধ পাথরে দুধ ঢালতে আসেন মানুষজন। আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন নগরী পুণ্ডুনগরখ্যাত বগুড়ার মহাস্থানগড়ের বিশাল এলাকাজুড়ে ইতিহাসের শত শত উপকরণ ও নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মহাস্থানগড়ে যে কোনো পথ ধরে হাঁটলেই হাজারো বছরের ইতিহাস জানা যাবে। তেমনি একটি প্রত্ননিদর্শন খোদার পাথর ভিটা। স্থানীয় লোকজন এটাকে দুধ পাথর বলে থাকে। মহাস্থানগড়ের ভিতরে শাহ সুলতান বলখী (র.) মাজারের উত্তর-পশ্চিম দিকে এ প্রত্নস্থানটির অবস্থান। খোদার পাথর ভিটা একটি বৌদ্ধ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। তবে মজার বিষয় হলো প্রত্নস্থানটির ‘খোদার পাথর ভিটা’ নামকরণটি হয়েছে এখানে অবস্থিত একটি লম্বা পাথরখণ্ডকে কেন্দ্র করে। পুণ্ডুনগরে অবস্থিত একটি টিলা বা ঢিবি। ঢিবিটির উপরিভাগে প্রাপ্ত গ্রানাইট পাথরের প্রকাণ্ড একটি চৌকাঠ থেকেই স্থানীয় জনগণ ঢিবিটির এ অদ্ভুত নামকরণ করেছে। এ প্রকাণ্ড চৌকাঠটিতে রয়েছে দরজার হুড়কো লাগাবার দুটি ছিদ্র, উপরের দিকে ফোকর এবং ফুলের নকশা। স্থানীয়দের কেউ কেউ এখানে নগ্ন পায়ে পাথরের এ চৌকাঠটিতে ভক্তি নিবেদন করেন। ধারণা করা হয় পাথরটিতে নকশা খোদাই করা আছে। সেজন্য একে ‘খোদাই পাথর’ বলা হতো, যা কালক্রমে ‘খোদার পাথর’ এ দাঁড়িয়েছে।
এই ভিটার ধ্বংসাবশেষ পাল শাসনামলের প্রথম দিকের (আনুমানিক খ্রিষ্ট্রীয় আট শতক) বলে জানা গেছে। ১৯৭০ সালে এ ঢিবি বা ভিটাতে খননকার্য করে একটি মন্দির এবং তার সঙ্গে ছোটখাটো কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। মন্দিরটি পূর্বাভিমুখী একটি আয়তাকার বৌদ্ধ মন্দির। এতে রয়েছে পাথরে বাঁধানো মেঝে এবং ভিত-দেয়াল। ভেতের ওপর স্থাপিত দেয়াল ছিল কাদামাটিতে গাঁথা ইটের তৈরি। দরজার চৌকাঠের বাজু, সরদল ও দরজার উপরের দিকের অলংকৃত অংশ সম্ভবত পাথরে নির্মিত হয়েছিল। এটি দীর্ঘাকার এবং চৌকাণাকৃতির মসৃণ পাথর যা সাধারণত প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, রাজা পরশুরাম এটি সংগ্রহ করে মসৃণ করে বলি দেওয়ার কাজে ব্যবহার করতেন।
প্রাচীন মন্দিরটি কালের গর্ভে ঠাঁই নিয়েছে। খোদার পাথরটি সবেধন নীলমনির মতো একটু আধটু ভক্তি শ্রদ্ধা আদায় করছে। হিন্দু ও আশেপাশের মুসলিম সম্প্রদায় বিভিন্ন সময় মানত করে পাথরটিতে দুধ ও তেল-সিদুঁর দেয়। অনেকে আবার বাড়ির গরুর প্রথম দুধ দিলে পাথরে ঢেলে দেয় নৈবেদ্য হিসেবে। অনেকে রোগমুক্তি কামনা করে এখানে। হিন্দু ভক্তরা অনেকে পাথরটিকে ব্রহ্মার বাহন বলে অনেক সময়। কেন এমনটি বলে তা জানা যায়নি। পাথরের উপরে একটি প্রাচীন বটগাছ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাছের তলায় মাঝে মাঝে বাউল সন্ন্যাসীর আড্ডা বসে, একতারা বাজিয়ে গান গায়।
প্রতিদিন বহু মানুষ মহাস্থানগড়ে বেড়াতে আসেন। তারা এই খোদার পাথর ভিটা দর্শন করেন। কেউবা দুধ পাথরে ঢেলে দেন। তেমনি একজন নন্দীগ্রামের পৌরএলাকা থেকে মহাস্থানে এসেছেন সনাতন ধর্মালবম্বী নীলকান্ত সাহা। তিনি মানত করেছেন এই পাথরে দুধ ঢেলে দিবেন। সেই দুধ ঢেলে দিয়েছেন পাথরের উপর। এমনিভাবে অনেক নারী পাথরে সিঁদুর দিচ্ছেন। তাদের বিশ্বাস এই পাথরে কিছু আছে।
প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের পরিচালক ড. নাহিদ সুলতানা জানান, খোদার পাথর ভিটা একটি প্রত্ন নিদর্শন। এখানে খনন করে মন্দিরের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেখানেই এই পাথরটি পাওয়া গিয়েছে। মন্দিরটি অষ্টম শতকে (পাল আমলে) নির্মিত বৌদ্ধ মন্দির।
মন্তব্য করুন