কুড়িগ্রামে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে জামানত হারানোর রেকর্ড হয়েছে। এবারে জেলার ৪টি সংসদীয় আসনে মোট ৩০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, এরমধ্যে জামানত হারিয়েছেন মোট ২৩ জন। ৪টি আসনে চারজন বিজয়ী হলেও তিনজন শুধু জামানত হারাননি, বাকি সবাই জামানত হারিয়ে স্বাধীনতার ৫৩ বছরে বিরল এক রেকর্ড গড়েছেন।
নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি জামানত হারিয়েছেন কুড়িগ্রাম-৪ আসনে। এই আসনে ১১ জন প্রার্থীর মধ্যে ১০ জনেরই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। রৌমারী, রাজিবপুর ও চিলমারী উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনে আওয়ামী লীগের তরুণ প্রার্থী অ্যাডভোকেট বিপ্লব হাসান পলাশ বিজয়ী হয়েছেন।
জেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, এবারে জেলার ৪টি আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ১৭ লাখ ৮২ হাজার ৩২ জন। ভোট পড়েছে ৫ লাখ ২৯ হাজার ৬৮৩টি। প্রাপ্ত ভোট প্রদানের হার ২৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। নির্বাচনে আশানুরূপ ফলাফল করতে পারেনি জাতীয় পার্টির দুর্গ খ্যাত লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থীরা। ৪টি আসনের মধ্যে ৩টি আসনেই জামানত হারিয়েছে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা।
কুড়িগ্রাম-১ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও সাবেক ৪ বারের সংসদ সদস্য এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক এবার মুখ রক্ষা করেছেন। একমাত্র তিনিই এই আসন থেকে ৮৮ হাজার ৪০৫ ভোট পেয়ে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রার্থী গোলাপফুল প্রতীকের আব্দুল হাই মাস্টার ৬১ হাজার ১২ ভোট পেয়েছেন। এই আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী থাকলে জয় পাওয়া কঠিন হয়ে যেত এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক এমপির। এই আসনটি ভুরুঙ্গামারী ও নাগেশ্বরী উপজেলা নিয়ে গঠিত। এখানে ৫ জন প্রার্থীর মধ্যে অপর তিনজন প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। তারা হলেন- বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের ফুলের মালা প্রতীক নিয়ে কাজী লতিফুল কবীর পেয়েছেন মাত্র ১ হাজার ৭৯ ভোট। ন্যাশনাল পিপলস পার্টির নুর মোহাম্মদ আম প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ১ হাজার ১৬৩টি ভোট এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির মনিরুজ্জামান খান ভাসানী একতারা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন মাত্র ১৬৬ ভোট।
জেলার গুরুত্বপূর্ণ কুড়িগ্রাম-২ আসনে নজর ছিল সবার। এই আসনে আওয়ামী লীগ থেকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাবেক এমপি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জাফর আলী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনে অংশ নিলেও পরে দলীয় সিদ্ধান্তে তিনি নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ান। তার সড়ে দাঁড়ানোর ফলে নিশ্চিত ছিলেন লাঙ্গল প্রতীকের জাতীয় পার্টির এমপি মো. পনির উদ্দিন আহমেদ। কিন্তু দিন গড়িয়ে যাওয়ার পর বর্ষীয়াণ আওয়ামী লীগ নেতা মো. জাফর আলীকে টপকিয়ে লাঙ্গলের প্রতীক নিয়ে ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার চিন্তা করলেও বিধিবাম হয়ে দাঁড়ায় তার পক্ষে। এই আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক চিকিৎসক হামিদুল হক খন্দকার সবাইকে চমকে দিয়ে ১ লাখ ১ হাজার ৯২৯ ভোট পেয়ে ট্রাক প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করেন। লাঙ্গল প্রতীকের সাবেক এমপি পনির উদ্দিন আহমেদ পেয়েছেন ৪৭ হাজার ১০০ ভোট। জেলার ফুলবাড়ী, রাজারহাট ও সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনে এই প্রথম ফুলবাড়ী উপজেলাবাসী নিজেদের এলাকার একজন সংসদ সদস্য পেলেন। এই আসনে ৭ জন প্রার্থীর মধ্যে অপর ৫ জন প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। তারা হলেন- স্বতন্ত্র প্রার্থী নাজমুল হোসেন ঈগল প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৩ হাজার ৭১৭ ভোট ও আবু সুফিয়ান পেয়েছেন ১ হাজার ১৪৯ ভোট, বাংলাদেশ কংগ্রেস পার্টির মকবুল হোসেন ডাব প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৮৮৯ ভোট, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির আব্দুস সালাম আম প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৫৬২ ভোট এবং বাংলাদেশ ওয়ার্কাস পার্টির হাতুড়ি প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ২৬৭টি ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন।
কুড়িগ্রাম-৩ আসনটি উলিপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত। এই আসনে ৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ৫ জন প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সৌমেন্দ্র প্রসাদ পান্ডে (গবা)। তিনি ৫৪ হাজার ৪৪৯ ভোট পেয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি ডা. আক্কাস আলী সরকারকে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করেছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী আক্কাস আলী পেয়েছেন ট্রাক প্রতীক নিয়ে ৩৪ হাজার ৩০ ভোট। এই আসনে জাতীয় পার্টির তরুণ প্রার্থী ব্যবসায়ী আব্দুস সোবহান সম্ভাবনা জাগালেও তাকেও জামানত হারাতে হয়েছে। তিনি লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৭ হাজার ২৭৭ ভোট। অপর ৪ জন জামানত হারানো প্রার্থীরা হলেন- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অ্যাডভোকেট সাফিউর রহমান নোঙ্গর প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন মাত্র ২৬০ ভোট, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের হাবিবুর রহমান গামছা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ২২২ ভোট, তৃণমূল বিএনপির আব্দুল বাতেন সোনালি আঁশ প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ১২৫ ভোট এবং ন্যাশনাল পিপলস পার্টির মোসাদ্দেকুল আলম আম প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন মাত্রা ৮৭ ভোট।
অপরদিকে কুড়িগ্রাম-৪ আসনে আওয়ামী লীগের তরুণ প্রার্থী অ্যাডভোকেট বিপ্লব হাসান পলাশ নৌকা প্রতীক নিয়ে ৮১ হাজার ১৩২ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন। এই আসনে অপর ১০ জন প্রার্থীর সবাই জামানত হারিয়েছেন। তারা হলেন- স্বতন্ত্র প্রার্থী মজিবুর রহমান বঙ্গবাসী ঈগল প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ১২ হাজার ৬৫২ ভোট, জাতীয় পার্টির এ কে এম সাইফুর রহমান পেয়েছেন ১২ হাজার ২৮১ ভোট, অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. ফারুকুল ইসলাম ঢেকি প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৭ হাজার ৮১৯ ভোট, শহিদুল ইসলাম শালু ট্রাক প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ২ হাজার ৫৪ ভোট, শাহ মো. নুর-ই-শাহী কলার ছড়ি প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৬৭১ ভোট ও অ্যাডভোকেট মাসুম ইকবাল কাঁচি প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ১২ ভোট, তৃণমূল বিএনপির আতিকুর রহমান খান সোনালি আঁশ প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৩৯৬ ভোট, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের মোহাম্মদ আবু শামিম হাবীব গামছা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ২০১ ভোট, জাতীয় পাটি, জেপি (মঞ্জু) রুহুল আমিন বাইসাইকেল প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ১১৩ ভোট এবং বাংলাদেশ কংগ্রেস পার্টির আব্দুল হামিদ ডাব প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৭০ ভোট।
মন্তব্য করুন