খাঁটি সরিষার তেল সবাই খুঁজলেও খবর রাখে না ঘানি ভাঙা সরিষার তেলের কথা। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের বেশিরভাগের কাছেই ঘানি জিনিসটা অপরিচিত। অথচ দুই দশক আগেও গ্রামে গেলেই দেখা মিলত ঘানির। প্রক্রিয়াজাতকরণের এই পুরোনো পদ্ধতি থেকে পাওয়া তেল মান ও বিশুদ্ধতার দিক থেকে ছিল সেরা।
কাঠের ঘানি দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে তেলের গাছ নামেও পরিচিত। এই পেশায় জড়িত ব্যক্তিরা পরিচিত কলু বা তেলী নামে। তবে ঘানিতে তেল ভাঙানোর প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ হওয়ায় আধুনিক মেশিনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হিমশিম খেতে খেতে এখন বিলুপ্তির পর্যায়ে। বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করছেন কলু সম্প্রদায়ের লোকজন।
তবে এখনো ভালোবেসে পূর্বপুরুষের পেশা ধরে রেখেছেন কেউ কেউ। এমন দুজন কলুর খোঁজ পাওয়া যায় দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলায়। তারা হলেন মো. আজিজার রহমান ও শফিকুল ইসলাম। বংশপরম্পরায় তারা এ পেশায় জড়িত।
আজিজার রহমান জানান, বাড়িতে তিনটি ঘানি বা তেলের গাছ আছে। তার বাবা ও দাদা ছিলেন তেলী। বাবা আব্দুল শাহর কাছ থেকে তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে এ পেশায় নেমেছেন।
সারা বছরই চলে এই তিনটি ঘানি। পাশের বিন্নাকুঁড়ির হাটে সপ্তাহের শুক্র ও মঙ্গলবার তেল বিক্রি করা হয়। এ ছাড়া প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ তেল কিনতে বাড়িতে আসে। শীতে ছোট-বড় সবাই সরিষার তেল গায়ে মাখেন, তাই চাহিদা বেড়ে যায়। বিক্রিও বেশি হয়।
আজিজার আরও বলেন, কাঠের ঘানির তেলের দাম অপেক্ষাকৃত বেশি হওয়ায় এর ক্রেতা কম। কিন্তু এর ক্রেতারা মূলত বিশুদ্ধতাকেই প্রাধান্য দেন।
এলাকার আরেক তেলী মো. শফিকুল ইসলাম। ৩০ বছর বয়সী এ যুবকের দাদা নসিরত ছিলেন এলাকার বিখ্যাত তেলী। বাবা আব্দুস সামাদও ছিলেন একই পেশায়। পাঁচ বছর আগে বাবার মৃত্যুর পর হাল ধরেছেন শফিকুল।
তার মতে, প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারা এবং সরিষা ও গো-খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। তবে এখনও অনেক ক্রেতা লাভ-ক্ষতির হিসাব না কষে খুঁজেন কাঠের ঘানিতে তৈরি শতভাগ বিশুদ্ধ সরিষার তেল। সে জন্য এখনো দু-একজন তেলী পূর্বপুরুষদের পেশা ধরে রেখেছেন। এক কালে গ্রামের হাট-বাজারে মাটির হাঁড়িতে ফেরি করে বিক্রি হতো খাঁটি সরিষার তেল। হাঁড়ির ঢাকনির নিচে থাকত তালের বিচির খোসা দিয়ে বানানো বাঁশের হাতলের ওড়ং। তেল তুলে দেওয়ার জন্য এই ওড়ং ব্যবহৃত হতো।
পেশাটি হারিয়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ হলো আধুনিক প্রযুক্তি। এ যুগের ব্যবসায়ীরা ইলেকট্রিক মোটর দিয়ে লোহার ঘানিতে উৎপাদিত তেল কম দামে বিক্রি করেন। কিন্তু সে তুলনায় পুরনো পদ্ধতির ঘানিতে রাত-দিন পরিশ্রম করে ফোঁটায় ফোঁটায় নিংড়ানো খাঁটি সরিষার তেলের দাম স্বাভাবিকভাবেই বেশি হয়। এ অসম প্রতিযোগিতাই কলুদের প্রধান প্রতিবন্ধকতা।
চিরিরবন্দরের ঘানি ভাঙা সরিষার তেলের ক্রেতাদের একটি বড় অংশ প্রবাসীরা। তারা বাড়িতে এলে এই তেল কিনে নিয়ে যান বা স্বজনদের মাধ্যমে সংগ্রহ করেন। কেজি হিসেবে ২৬০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হয় এই তেল।
জোতরামধনপুর গ্রামের কলু সম্প্রদায়ের ইতিহাস শত বছরের। বর্তমানে টিকে থাকা কলু পরিবার দুটি বংশপরম্পরায় ৬০-৬৫ বছর ধরে এই ব্যবসা করে আসছেন।
মন্তব্য করুন