পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়েই মূলত ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা হয়েছিল। প্রায় ২০০ বছর শাসন করার পর ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দিয়ে ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয় ব্রিটিশরা। তবে এ স্বাধীনতা এমনি এমনি আসেনি। এর পেছনে রয়েছে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস।
ঐতিহাসিক প্রজা বিদ্রোহ ছিল তেমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নাম। ১৭৮৩ সালে তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের ফতেপুর পরগণার জমিদার শিবচন্দ্র রায় আরেক ব্রিটিশবিরোধী নারী জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানীকে সঙ্গে নিয়ে এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। জমিদার শিবচন্দ্র রায় আজ বেঁচে নেই।
তবে তার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে আজও ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার জমিদার বাড়িটি। যা সকলের কাছে ইটাকুমারী জমিদার বাড়ি নামে পরিচিত। যে বাড়িটি ছিল একসময় প্রজা বিদ্রোহের সূতিকাগার। সেই বাড়িটি আজ অযত্ন, অবহেলা, সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এমনকি এখনও পর্যন্ত ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি জমিদার বাড়িটির।
রংপুর শহর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার পূর্বে পীরগাছা উপজেলার ইটাকুমারী ইউনিয়নে ঐতিহাসিক জমিদার বাড়িটির অবস্থান। জমিদার শিবচন্দ্রের নামে এ এলাকায় দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হলেও তার স্মৃতিবিজড়িত জমিদার বাড়িটি সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি কেউ।
সরেজমিনে ইটাকুমারী জমিদার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জমিদার বাড়িতে নেই কোনো দরজা বা জানালা। দেয়াল, ছাদ থেকে খসে পড়েছে পলেস্তারা । দেয়াল কোথাও ভাঙ্গা, কোথাও ধরেছে ফাটল। ছাদের কিছু জায়গা ভেঙে গেছে। লতাপাতায় ঢেকে গেছে অনেক দেয়াল। কক্ষগুলোর ভেতরে ময়লা আবর্জনার স্তূপ। সামনে খোলা মাঠ। নেই কোনো সীমানাপ্রাচীর। যেন গরু-ছাগলের চারণভূমি। সবকিছু উন্মুক্ত। দর্শনার্থী যারা এসেছেন তারা ঘুরে ফিরে দেখছেন আর আক্ষেপ করছেন এক সময়কার প্রভাবশালী জমিদারের বাড়ির এ পরিণতি দেখে।
বাড়ির পাশে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শত বছরেরও বেশি পুরোনো একটি কাঠগোলাপের গাছ। স্থানীয়দের ধারণা, এত পুরোনো ও বড় কাঠগোলাপ গাছ বাংলাদেশে হয়তো আর দ্বিতীয়টি নেই।
জানা গেছে, শিবচন্দ্র রায় ছিলেন তৎকালীন ফতেপুর পরগনা অর্থাৎ বর্তমান ইটাকুমারীর জমিদার। ব্রিটিশদের ইজারাদার অত্যাচারী দেবী সিংহের শোষণ-নিপীড়ন থেকে কৃষক প্রজাদের বাঁচাতে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তিনি। যার জন্য তাকে দেবী সিংহের হাতে বন্দীও হতে হয়েছিল। সেই বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ইতিহাসখ্যাত জয়দূর্গা দেবী চৌধুরানীসহ আশপাশের বেশ কয়েকজন জমিদারকে তার বাড়িতে ডেকে নিয়ে সংগঠিত করে ১৭৮৩ সালে ঐতিহাসিক প্রজা বিদ্রোহের ডাক দেন তিনি।
তার ডাকে সাড়া দিয়ে দিনাজপুরের কৃষক নেতা নূরুল দীনও এ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রজা বিদ্রোহ ছিল একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন। আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি ইংরেজদের জানান দিয়েছিলেন তৃণমূল পর্যায় হতেও বড় শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়। ইটাকুমারী জমিদার বাড়িটি ছিল তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার দ্বিতীয় নবদ্বীপ। শিক্ষা, সাংস্কৃতিক বাতিঘর হিসেবে ইটাকুমারীর খ্যাতি সেসময় গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল।
ইটাকুমারী শিবচন্দ্র রায় কলেজের শিক্ষার্থী সাব্বির আহমেদ বলেন, ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ এখানে আসে। ছাদের কিছু অংশ ভেঙে যাওয়ায় এটা এখন অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ দর্শনার্থীদের জন্য। স্থানীয় কিছু দুর্বত্ত রাতের আঁধারে ইট চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। এসব যেন দেখার কেউ নেই।
পাওটানাহাট থেকে ঘুরতে আসা মমিনুল ইসলাম বলেন, জমিদার বাড়িতে আসার রাস্তার খুব বাজে অবস্থা। আমরা অনেক দূর ঘুরে বিকল্প রাস্তা দিয়ে এখানে এসেছি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টির দিকে নজর দেওয়া দরকার।
স্থানীয় বাসিন্দা প্রিয়নাথ সরকার বলেন, ইতোপূর্বে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকে জমিদার বাড়িটি পরিদর্শন করা হলেও এখন পর্যন্ত ঐতিহাসিক স্থাপনাটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। অচিরেই ইটাকুমারী জমিদার বাড়িকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট দাবি জানাচ্ছি।
দামুরচাকলা থেকে ঘুরতে আসা সাইফুল ইসলাম নামে এক যুবক বলেন, শিবচন্দ্র রায় প্রজা বিদ্রোহের মাধ্যমে ইংরেজদের জানান দিয়েছিলেন তৃণমূল পর্যায় থেকেও অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়। তার স্মৃতি বিজড়িত এ বাড়িতে এলে তাই কেমন যেন একটা শান্তি লাগে। তার নামে এ ইউনিয়নে একটি উচ্চ বিদ্যালয় ও একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হলেও তার জমিদার বাড়িটি সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না। আমাদের দাবি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জমিদার বাড়িটিকে যেন পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন এবং বাড়িটি সংরক্ষণে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নাজমুল হক সুমন কালবেলাকে বলেন, আমরা ইতোমধ্যে কয়েকবার এ জমিদার বাড়ি পরিদর্শন করেছেন। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছি যেন ইটাকুমারী জমিদার বাড়িকে প্রত্নতাত্ত্বিক পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই সঙ্গে পুরোনো অবকাঠামোকে বজায় রেখে কীভাবে এর উন্নয়ন করা যায় সে ব্যপারে আমরা স্থানীয় চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করেছি। খুব শিগগির ঐতিহাসিক এ জমিদার বাড়িটি রক্ষায় প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।
মন্তব্য করুন