সাড়ে তিন যুগের প্রতীক্ষার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারও কড়া নাড়ছে রাকসু নির্বাচন। দীর্ঘ বিরতির পর শিক্ষার্থীরা আগামী বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) পাচ্ছেন ভোটের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রার্থীরা একের পর এক ইশতেহার ঘোষণা করছেন।
ক্যাম্পাসজুড়ে এখন পোস্টার, লিফলেট, মাইকিং আর প্রতিশ্রুতির জোয়ার। কেউ দিচ্ছেন পূর্ণাঙ্গ আবাসিকতার মাস্টারপ্ল্যান, কেউ বিবাহিত শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন হল নির্মাণের আশ্বাস, আবার কেউ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন আবাসন ভাতা চালুর। এ ছাড়া ৫০ শয্যাবিশিষ্ট মেডিকেল সেন্টার, ক্যাম্পাসে চাকরির সুযোগ, প্রশাসনিক ও একাডেমিক সংস্কারের ঘোষণাও আসছে একের পর এক ইশতেহারে।
তবে এসব প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন। অনেকের মতে, ইশতেহারের অনেক প্রতিশ্রুতি দীর্ঘমেয়াদি, অবাস্তব বা ছাত্র প্রতিনিধিদের এখতিয়ারের বাইরে। কেউ কেউ বলছেন, এসব ‘আকাশকুসুম’ প্রতিশ্রুতি আসলে ভোটার আকৃষ্ট করার কৌশল, শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নয়।
ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী’ প্যানেল গত ২০ সেপ্টেম্বর তাদের ইশতেহার ঘোষণা করে। তারা নির্বাচিত হলে ১২ মাসে ২৪টি সংস্কারমূলক উদ্যোগ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে।
ছাত্রদল তাদের ইশতেহার প্রকাশ করে গত রোববার (১২ অক্টোবর), যেখানে ১০ দফায় ৩৬টি প্রতিশ্রুতি তুলে ধরা হয়।
সংগঠনের ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দীন আবীর বলেন, বিজয়ী হলে শামসুজ্জোহার শহীদ হওয়ার দিনটিকে জাতীয় শিক্ষক দিবস ঘোষণার দাবি তোলাসহ নতুন হল নির্মাণ, বিবাহিত শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা, অনাবাসিকদের জন্য মাসিক ভর্তুকি এবং ক্যাম্পাসের ক্যান্টিন ও পরিবহনব্যবস্থা উন্নত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
একই দিন ইসলামী ছাত্র আন্দোলন সমর্থিত ‘সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ’ ১২ দফার ইশতেহার ঘোষণা করে। এর আগে ৯ অক্টোবর বাম সমর্থিত ‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী সংসদ’ ১৬ দফার ইশতেহার প্রকাশ করে। ‘রাকসু ফর র্যাডিক্যাল চেঞ্জ’ নামের আরেকটি প্যানেল তিনটি প্রধান লক্ষ্য সামনে রেখে ১৪ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ১৬ সেপ্টেম্বর ‘সার্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’ ১২ দফা প্রতিশ্রুতি তুলে ধরে একমাত্র ভিপি প্রার্থী তাসিন খান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক তিন সমন্বয়কের নেতৃত্বে গঠিত ‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’ও ১২ দফার ইশতেহার প্রকাশ করেছে।
এ ছাড়া অন্যান্য প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও নানা সুবিধা ও পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন ভোটারদের আকৃষ্ট করতে।
রাকসুর প্রথম গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয় ১৯৬২ সালে, যা পরবর্তীতে সংশোধিত হয় শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে। বিদ্যমান গঠনতন্ত্র অনুযায়ী রাকসুর মূল কাজ হলো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম আয়োজন, সাময়িকী প্রকাশ, মানবিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, আলোচনা সভা আয়োজন এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা পরিচালনা। অর্থাৎ, রাকসুর কার্যপরিধি প্রশাসনিক বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, বরং শিক্ষার্থীদের সহপাঠ্যক্রমিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশে সীমাবদ্ধ।
তবুও অনেক প্রার্থী তাদের ইশতেহারে এমন সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা রাকসুর ক্ষমতার বাইরে। ছাত্রশিবিরের ইশতেহারে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার সম্প্রসারণ, চিকিৎসাকেন্দ্রকে পূর্ণাঙ্গ মেডিকেলে রূপান্তর, সিসি ক্যামেরা স্থাপন, নারী সিকিউরিটি সেল ও হেল্পলাইন চালু, ই-কার সার্ভিস এবং নারী শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক মসজিদ নির্মাণের কথা বলা হয়েছে।
ছাত্রদলের ইশতেহারে নতুন হল নির্মাণ, পূর্ণ আবাসিকতা নিশ্চিত করা, বিবাহিত শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা হল, অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তুকি, ক্যান্টিনে খাবারের মান নিয়ন্ত্রণ, রেলস্টেশন সচল করা এবং বাস সার্ভিস বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
বামপন্থি প্যানেল গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদের ইশতেহারে রাকসুর কাঠামোগত সংস্কার, নির্বাচনের তারিখ একাডেমিক ক্যালেন্ডারে অন্তর্ভুক্ত করা, গবেষণায় বাজেটের ১০ শতাংশ বরাদ্দ, আবাসনসংকট নিরসনে হলে সন্ত্রাসমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং নারীবান্ধব ক্যাম্পাস গড়ার লক্ষ্যে সাইবার সুরক্ষা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
আধিপত্যবিরোধী ঐক্য প্যানেল প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পূর্ণাঙ্গ আবাসিকতা, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে স্বচ্ছতা, মেডিকেল সেন্টারকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা, প্রশাসনিক কার্যক্রম ডিজিটালাইজ করা এবং ক্যাম্পাসে তিন হাজার শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার।
‘রাকসু ফর র্যাডিক্যাল চেঞ্জ’ প্যানেল শিক্ষকদের জবাবদিহির আওতায় আনতে অডিট টিম গঠন, ভর্তি ও ফি প্রদানের জন্য একক ডিজিটাল অ্যাপ চালু এবং একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে ‘রিসার্চ অ্যান্ড ইমপ্যাক্ট অফিস’ প্রতিষ্ঠা, ভর্তি থেকে সনদ প্রদান পর্যন্ত সমন্বিত ডিজিটাল সলিউশন চালু এবং রাকসু সভাপতি ও উপাচার্য নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে নির্ধারণের দাবি তুলেছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদুল আলম তন্ময় বলেন, রাকসু নির্বাচন ঘিরে অনেক প্রার্থী যুগোপযোগী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। তবে এর মধ্যে অনেক ইশতেহার ছাত্র সংসদের বাস্তব কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিছু প্রতিশ্রুতি এমন, যা শুনলে মনে হয় এটি কোনো জাতীয় নির্বাচনের ইশতেহার।
ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী নাজমুল আলমের মতে, অনেক প্রার্থী এমন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যা তাদের দায়িত্বের আওতায় পড়ে না। কিছু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করাও কঠিন হতে পারে। অনেক সময় এগুলো শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়ানোর কৌশল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সুলতান মাহমুদ বলেন, বেশির ভাগ প্রার্থীর ইশতেহারই অবাস্তব ও অতিরঞ্জিত। রাকসুর ভূমিকা মূলত প্রশাসনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা, বাস্তবায়ন নয়। এক বছরের মেয়াদে বড় কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, অথচ প্রার্থীরা সেসব বিষয়েই জোর দিচ্ছেন। এতে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত স্বার্থের বিষয়গুলো আড়ালে পড়ে যাচ্ছে। জনপ্রিয় কিন্তু অবাস্তব প্রতিশ্রুতি দেওয়া কোনো ভালো চর্চা নয়।
মন্তব্য করুন