যুগ যুগ ধরে অনেক প্রতিভাবান শিল্পীর অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গন। মূলধারার গণমাধ্যম ও দর্শকের কাছে এই শিল্পীদের অনেকেই অচেনা, তবে নিজস্ব পরিসরে তাদের রয়েছে বেশ পরিচিতি। কয়েক বছর ধরে কিছু জনপ্রিয় মিউজিক্যাল প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছেন এমন অনেক শিল্পী। গত বছরও আমরা এমন দুজন শিল্পীকে পেয়েছি যারা আলো ছড়িয়েছে দেশের সংগীতাঙ্গেনে। তারা হলেন আলেয়া বেগম, হামিদা বানু ও জহুরা বাউল।
‘বাউল মাতা’ হিসেবে পরিচিত লোকসংগীতশিল্পী আলেয়া বেগমের রয়েছে দীর্ঘ ৫০ বছরের সংগীতজীবন। বিচ্ছেদ, পালাগান, জারিগান ও আধ্যাত্মিক গানের জন্য বিখ্যাত এই শিল্পী লিখেছেন ১,০০০-এর বেশি গান। ‘গুণিন’-এর মতো জনপ্রিয় চলচ্চিত্রেও তিনি গেয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা থাকলেও তিনি মূলত তার আশপাশের মানুষজন ও এলাকাবাসীদের মধ্যেই পরিচিত ছিলেন। গত বছর কোক স্টুডিও বাংলা’র ‘কথা কইয়ো না’ গানে তার হৃদয়স্পর্শী পারফরম্যান্স তাকে মূলধারার মিডিয়ার নজরে নিয়ে আসে। হঠাৎই সংগীতপ্রেমীদের মধ্যে তাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এই স্থানীয় শিল্পী রাতারাতি হয়ে ওঠেন দেশের সবার প্রিয়। গানটির সাফল্য শুধু আলেয়া বেগমকেই নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত করিয়ে দেয়নি, বরং বাংলাদেশি লোকসংগীতের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকেও তুলে ধরেছে।
একইভাবে, সিলেটের লোকসংগীতশিল্পী হামিদা বানু। দীর্ঘদিন ধরে হাসন রাজার পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হামিদা বানুর পেশাদার হিসেবে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতাই ছিল না। হাসন রাজার গানের সঙ্গে তার রয়েছে গভীর সংযোগ। কোক স্টুডিও বাংলার দ্বিতীয় সিজনে ‘দিলারাম’ গান দিয়ে তিনি প্রথমবার মঞ্চে ওঠেন। তার শ্রুতিমধুর কণ্ঠের গান সবার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। আলেয়া বেগমের মতোই হামিদা বানুও তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
আলেয়া বেগম ও হামিদা বানুর মতোই দর্শক-শ্রোতাদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন আরেক গ্রামীণ প্রতিভা জহুরা বাউল। ‘বনবিবি’ গানে তার শক্তিশালী ও সুরেলা কণ্ঠে মুগ্ধ হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। তিনি এখন নারী শিল্পীদের জন্য অনুপ্রেরণা। গ্রামের নারীদের ওপর তার প্রভাবের বিষয়টি ‘বনবিবি’ গানে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। এই গানে তার নেতৃত্বে বাউল নারীদের দল মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। ‘মেঘদল’-এর মতো জনপ্রিয় ব্যান্ডের সঙ্গে একই মঞ্চে গান করলেও তার শক্তিশালী পরিবেশনা বিশেষভাবে দর্শক-শ্রোতার মন জয় করে নিয়েছে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের এ বছরের থিম ‘ইনস্পায়ার ইনক্লুশন’, যার অর্থ হচ্ছে নারীদের জন্য এমন পরিবেশ তৈরি করা যেখানে তারা সমাজে নিজের জায়গা সম্পর্কে জানতে পারে। এর সঙ্গে এ গল্পগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক দূরত্ব ঘুচে যাচ্ছে। সে সঙ্গে আলেয়া, হামিদা ও জহুরার মতো নারীরা নিজেদের প্রতিভা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরার সুযোগ পাচ্ছেন। নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি এমন অন্তর্ভুক্তি অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করছে। বোঝা যায়, প্রতিভার প্রকাশের জন্য শিল্পীর পারিপার্শ্বিক অবস্থা কিংবা পূর্ব পরিচিত গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রতিভা নিজে থেকেই বিকাশের পথ খুঁজে নেয়।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদ্যাপনের এই ক্ষণে এসব গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, অন্তর্ভুক্তি ও ক্ষমতায়নের ফলে অনেক নতুন কণ্ঠ তাদের প্রতিভা তুলে ধরার সুযোগ পায়। এতে সংগীত শিল্পের পাশাপাশি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
মন্তব্য করুন