বৃষ্টির প্রবণতা বাড়ায় প্রায় সারা দেশে চার দিন অস্বস্তিকর গরমের পরে কমতে শুরু করেছে তাপমাত্রা। শনিবার (১৮ মে) সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টি হয়েছে। আকাশ মেঘলা থাকায় নেই প্রখর রোদ। দেশে কমে এসেছে তাপপ্রবাহের বিস্তার। ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলসহ খুলনা, রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যাবে বলে ৪৮ ঘণ্টার যে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল, তা ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই প্রত্যাহার করে নিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আগামী ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টির প্রবণতা বাড়বে। আগামী ২২ বা ২৩ মে বঙ্গোপসাগরে একটি নিম্নচাপ তৈরি হতে পারে। পরবর্তীতে এটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে। এদিকে নরসিংদী, টাঙ্গাইল ও গাজীপুরে বজ্রপাতে সাতজন মারা গেছেন।
শনিবার বাগেরহাটের মোংলায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৮ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। এদিন ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এক দিনের ব্যবধানের ঢাকার তাপমাত্রা কমেছে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
শনিবার সিলেটে দেশের সর্বোচ্চ ১০১ মিলিমটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী, পটুয়াখালী, ভোলা ও চুয়াডাঙ্গায় বৃষ্টি হয়েছে।
সারা দেশেই বৃহস্পতিবার মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ ছিল, শুক্রবার তা ছিল ৫৩ জেলায়। শনিবার তাপপ্রবাহের বিস্তৃতি কমে ৯ জেলায় নেমেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর পূর্বাভাসে জানিয়েছে, গোপালগঞ্জ, রাজশাহী, নোয়াখালী, কক্সবাজার, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলার ওপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা প্রশমিত হতে পারে। পশ্চিমা লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ থেকে উত্তর–পশ্চিম বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। আগামী পাঁচ দিনের পূর্বাভাসে বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে।
শনিবার সন্ধ্যা থেকে রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রাজশাহী, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগের দু’এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা/ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। পাশাপাশি কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এ সময়ে সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
রোববার সন্ধ্যা থেকে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং খুলনা ও বরিশাল বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা/ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এ সময়ে সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা ১-২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে।
আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক বলেন, তাপপ্রবাহ অনেকটা প্রশমিত হয়েছে কয়েকটি অঞ্চল থেকে। সে জন্য তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন দেশের ৯টি অঞ্চলে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ আছে। রোববার এসব অঞ্চলেও তাপপ্রবাহ প্রশমিত হয়ে যাবে। শনিবার রাতে ও রোববার ঢাকায় বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
তিনি বলেন, ২৩ বা ২৩ মের দিকে পশ্চিম মধ্য বঙ্গোপসাগর বা দক্ষিণ মধ্য বঙ্গোপসাগরে ভারতীয় উপকূলের নিকটবর্তী এলাকায় একটি লঘুচাপ তৈরি হতে পারে। লঘুচাপের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। ভূমির যত কাছে থাকবে তত শক্তি কম হবে।
ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস : আগামী ২২ বা ২৩ মে বঙ্গোপসাগরে সম্ভাব্য নিম্নচাপটি ২২ মে-তেই ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে। তীব্রতা বাড়লে ঘূর্ণিঝড়টির নাম হবে ‘রেমাল’; আরবি ভাষায় শব্দটির অর্থ ‘বালি’।
ভারতের আবহাওয়া দপ্তর চলতি মে মাসে বঙ্গোপসাগরে দুটি নিম্নচাপ তৈরির পূর্বাভাস দিয়েছে। আগামী ২২ মে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে একটি নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে। এই সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় আগামী ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উপকূলে পৌঁছাতে পারে।
কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ জানান, আগামী ২২ মের পর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি ও শক্তিশালী হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় চারটি প্রধান উপাদানের মধ্যে ইতোমধ্যে তিনটির উপস্থিতি রয়েছে মধ্য ও দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে। আগামী ২৫ থেকে ২৭ মে এর মধ্যে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূল থেকে শুরু করে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উপকূলের মধ্যবর্তী এলাকার ওপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানার প্রবল সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এই ঘূর্ণিঝড়ের জেরে আগামী ২৪ মে রাত থেকে বৃষ্টি শুরু হতে পারে উপকূলীয় এলাকায়। বৃষ্টি চলতে পারে ২৭ মে পর্যন্ত। ধারণা করা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশের মধ্যে এটি কোথাও আছড়ে পড়তে পারে।
এদিকে বজ্রপাতে তিন জেলায় ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। নরসিংদী সদর উপজেলায় বজ্রপাতের পৃথক ঘটনায় মা–ছেলেসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সদর উপজেলার চরাঞ্চল আলোকবালী ইউনিয়নের মধ্যপাড়া গ্রামে মা–ছেলেসহ তিনজন এবং হাজীপুর এলাকায় এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
নিহতরা হলেন- আলোকবালী উত্তরপাড়ার কামাল মিয়ার স্ত্রী শরিফা বেগম (৫০), তার ছেলে ইকবাল হোসেন (১২), করম আলীর ছেলে কাইয়ুম মিয়া (২২) এবং চকপাড়া গ্রামের মোছলেহউদ্দিন (৫০)।
শরিফা বেগমের স্বামী আহত কামাল মিয়া বলেন, স্ত্রী, সন্তান ও একজন শ্রমিক নিয়ে সকাল থেকে মাঠে ধান কাটছিলাম। সকাল ১০টার দিকে হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়। এ সময় শরীরে পলিথিন দিয়ে ঢেকে বৃষ্টি থেকে রক্ষার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ বজ্রপাত হলে আমরা আহত হই। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে নরসিংদী সদর হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক সুফিয়া বেগম, ইমন মিয়া ও কাইয়ুম মিয়াকে মৃত ঘোষণা করেন।
এদিকে সদর উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোমেন মিয়া বলেন, বেঙ্গল এলাকার একটি টেক্সটাইল মিলে বজ্রপাতে মোসলেম মিয়া নামের এক টেক্সটাইল শ্রমিক নিহত হয়েছেন। মিলের আঙিনায় কাজ করার সময় বজ্রপাতে তিনি মারা যান। তার বাড়ি হাজীপুর ইউনিয়নের চরহাজীপুর গ্রামের খাগেরচর এলাকায়।
গাজীপুরের শ্রীপুরের গলদাপাড়া গ্রামে ধান শুকানোর সময় বজ্রপাতে ফাতেমা আক্তার (৪৫) নামে এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। তিনি উপজেলার গলদাপাড়া গ্রামের মো. নূর হোসেনের স্ত্রী। স্থানীয়রা জানান, ফাতেমা আক্তার শনিবার সকালে তার বাবার বাড়িতে ধান শুকানোর কাজ করছিলেন। দমকা বাতাস ও বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে দেখে তিনি উঠান থেকে ধান উঠাতে যান। এ সময় বজ্রপাত হলে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ফাতেমা। পরে তাকে উদ্ধার করে শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এদিকে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার নোয়াবাড়ি গ্রামে ধান কাটতে গিয়ে বজ্রপাতে দুই ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন- দিনাজপুরে বীরগঞ্জ উপজেলার চকদফর গ্রামের নুরু শেখের ছেলে আফজাল হোসেন (৫২) এবং একই গ্রামের আয়নাল হকের ছেলে আমির হোসেন (৫০)। তারা সম্পর্কে খালাতো ভাই।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সোহরাব আলী জানান, এক সপ্তাহ ধরে আফজাল ও আমির উপজেলার আউলিয়াবাদ বাজারে ঘর ভাড়া নিয়ে আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ধান কাটার কাজ করছিলেন। শনিবার ভোরে নোয়াবাড়ি গ্রামে হযরত আলীর ক্ষেতে ওই দুজনসহ চার শ্রমিক ধান কাটছিলেন। এ সময় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত শুরু হয়। একপর্যায়ে শ্রমিকরা বাড়ি যাওয়ার পথে বজ্রপাতে আফজাল ও আমির ঘটনাস্থলেই মারা যান।
মন্তব্য করুন