মো. খায়রুল হাসান
প্রকাশ : ০২ জুন ২০২৫, ০৫:৪৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংকের লভ্যাংশ ঘোষণা না করার কারণ  

অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংকের লভ্যাংশ ঘোষণা না করার কারণ  

পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের পুরো সময়টাজুড়ে ছিল দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুটের মহোৎসব। ব্যাংক লুটেরাদের নেতৃত্বে ছিল চট্টগ্রামভিত্তিক বিতর্কিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলম মাসুদ ওরফে এস আলম। সরকারের প্রকাশ্য মদদে এস আলমের হাতে তুলে দেওয়া হয় দেশের সেরা ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশসহ আরও ৮টি ব্যাংক। এগুলোর অধিকাংশই শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক।

বিগত সরকারের সময়ে এস আলম গ্রুপের সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম, ভুয়া ও কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ গ্রহণ, ঋণ জালিয়াতি, বিদেশে অর্থপাচার, নিয়োগ বাণিজ্য এবং লুটপাটের কারণে ঐসব ব্যাংক একেবারে শূন্য হয়ে যায়। জনগণের কষ্টার্জিত আমানত ডাকাতি করা হয়। ব্যাংকগুলোতে প্রয়োজনীয় টাকা না পেয়ে জনগণের আহাজারি বাড়তে থাকে। অথচ বিগত সরকারের সময়ে ব্যাংকগুলোর অনিয়মের তথ্য গোপন করে রাখা হয়েছে। কৃত্রিমভাবে ব্যাংকগুলোতে বাঁচিয়ে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে তাদের সহায়তা করা হতো। শ্রেণিকৃত ও খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন রাখা হয়েছে। ফলে এসব ব্যাংকের প্রকৃত অবস্থা জনগণ জানতে পারে নাই।

৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে সরকার ঐসব ব্যাংকের বিতর্কিত বোর্ড ভেঙে দিয়ে নতুন বোর্ড গঠন করে। দেশের প্রথিতযশা ব্যাংকার, সেন্ট্রাল ব্যাংকার, হিসাববিদ, অডিটর ও অ্যাকাডেমিকসদের সমন্বয়ে নতুন বোর্ড গঠন করা হয়। দায়িত্ব নিয়ে নতুন বোর্ডগুলো প্রথমেই এই সব ব্যাংকগুলোতে টাকা পাচার ও ঋণের নামে অবৈধ লুটপাট বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণ করে। পাশাপাশি বিগত বোর্ডগুলোর সময়ে সংঘটিত অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত করার মাধ্যমে প্রকৃত চিত্র জনসম্মুখে তুলে ধরে। ফলে ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের খবর প্রকাশিত হয়। একইসাথে এই সকল বোর্ড বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যাংকগুলোকে পুনরায় দাঁড় করানোর জন্য জান-প্রাণ দিয়ে কাজ করতে থাকে। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি ব্যাংক ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাকি ব্যাংকগুলোও ঘুরে দাঁড়ানোর পথে।

গত ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সমাপ্ত হওয়া আর্থিক বছরের জন্য যে সব ব্যাংক কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে নাই, সেগুলো মূলত বিগত সরকার ও বোর্ডের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণেই। এই ব্যাংকগুলোর ৮০% থেকে ৯৫% ঋণ এখন ক্লাসিফাই এবং খেলাপি ঋণ। বর্তমান বোর্ডের এ ক্ষেত্রে কোনো দায়বদ্ধতা নাই। ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি, মূলধন ঘাটতি এবং দুর্বল আর্থিক পরিস্থিতির কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের লভ্যাংশ ঘোষণার অনুমতি দেয় নাই।

যে সব ব্যাংক লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে নাই সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- এবি ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, এসবিএসি ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক।

এসব ব্যাংকগুলোর মধ্যে কেবল এস আলমের দখলে ছিল মোট ১০টি ব্যাংক। এগুলো হলো আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক। এসব ব্যাংকের ৮০ শতাংশের বেশি সম্পদ এককভাবে লুট করে এস.আলম, যার পরিমাণ প্রায় আড়াই লক্ষ কোটি টাকা। ব্যাংক ডাকাত এস.আলম তার কাজের মেয়ে, ড্রাইভার, চাকরবাকর, আত্মীয়স্বজন, এলাকাবাসী, চাকরিপ্রার্থীদের নামে ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা লোপাট করে। লোপাটকৃত টাকা এস আলম গ্রুপ বিদেশে পাচার করে। বিশাল পরিমাণ ঋণ খেলাপি হওয়ার কারণেই ব্যাংকগুলো ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলো কোনো লভ্যাংশ দিতে পারছে না।

এস আলমের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ছিলো ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান। ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা লুট করে সে অ্যামেরিকায় ৩০০টি বাড়ি ক্রয় করে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিল শেখ হাসিনা সরকারের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে পরিচিত নজরুল ইসলাম মজুমদার। তিনিও এক্সিম ব্যাংকটিকে প্রায় দেওলিয়ার পর্যায়ে নিয়ে যান।

আর্থিক খাতের আরেক মাফিয়া সালমান এফ রহমান ওরফে দরবেশ ছিল আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান। তিনি তার নিজের ব্যাংক লোপাটের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ও রূপালী ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেন, যা এখন পুরোটাই খেলাপি ঋণ। এসব কারণে ব্যাংকখাতে এখনো চরমমাত্রায় অস্থিরতা বিরাজ করছে।

এগুলোর বিপরীতে নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত বোর্ডগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যাংকগুলোকে সবল করতে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে নতুন এসব বোর্ডের চেয়ারম্যানগণ খুবই অভিজ্ঞ এবং পরিশ্রমী। যেমন- ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মো. ফরিদ উদ্দিন, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান এনসিসি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আমীন, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. এম সাদিকুল ইসলাম এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এমডি মোহাম্মদ আবদুল মান্নান। এরা সবাই মিলে ব্যাংকিং খাতটাকে মেরামতের কাজ করছেন। ইতোমধ্যে ব্যাংকখাতে লুটপাট বন্ধের ফলে জনগণের আস্থা ফিরে এসেছে।

একইসাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই ঐসব ব্যাংকখেকো লুটেরাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তৎপর রয়েছেন। তাদের এদেশীয় সম্পদ জব্দ এবং বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া সম্পদ ফিরিয়ে আনার জন্য সম্ভাব্য সকল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি তাদের আইনের আওতায় আনতে এবং দুর্বল ব্যাংকগুলো সবল করার জন্য ইতোমধ্যে সরকার ‘ব্যাংক রেজ্যুলেশন অর্ডিন্যান্স-২০২৫’ পাস করেছে।

সব মিলিয়ে ব্যাংকখাতে যখন সংস্কার শুরু হয়েছে এবং লুটেরাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি চলছে, ঠিক সেই মুহূর্তে লুটেরাদের এ দেশীয় পেইড এজেন্ট খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং নতুন বোর্ডের বিরুদ্ধে বানোয়াট প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। এজন্য তারা ভাড়াটিয়া এজেন্ট দিয়ে সামাজিক মাধ্যম এমনকি মূলধারার কিছু মিডিয়ার মাধ্যমে অপপ্রচার চালাচ্ছে। মূলত লুটেরা এসব অলিগার্ক ও তাদের পেইড এজেন্টের আঁতে ঘা লেগেছে এবং তারা এখন একেবারে দিশাহারা হয়ে পাগলের মত আচরণ করছে। দেশবাসীর সামনে তাদের মুখোশ খুলে দেওয়ার এখনই মোক্ষম সময়। জাতীয় সম্পদ লুটের প্রতিটি হিসাব পঁই পঁই করে নেয়ার এখনই সময়। লুটেরাদের একবিন্দুও ছাড় নয়। দেশবাসীর এখনই সোচ্চার হওয়ার সময়।

লেখক : মো. খায়রুল হাসান, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের হেড অব পাবলিক অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ব্র্যান্ড কমিউনিকেশন।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জি-৭ এ আমন্ত্রণ না পেয়ে ঘরে-বাইরে বিপদে মোদি

ফরিদপুরে মাহিন্দ্রায় বাসের ধাক্কা, নিহত বেড়ে ৫

লুটপাটের জন্য বরাদ্দ ৪৬ হাজার কোটি টাকা আটকে দিল সরকার

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে যে বার্তা দিল আবহাওয়া অফিস

এবার ছিনতাইয়ের কবলে মুক্তিযোদ্ধা দম্পতি

ফিরতি ঈদযাত্রায় আজ মিলবে ১৪ জুনের টিকিট 

ছাগলের মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে চোরের এ কেমন কাণ্ড

সিরিয়া-ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি হামলা

ভুল করে পাঠানো মেইল ফেরত আনবেন যেভাবে 

কুমিল্লায় বিদেশি পিস্তলসহ হাতেনাতে তিন যুবক গ্রেপ্তার

১০

আজ থেকে শুরু হজের আনুষ্ঠানিকতা

১১

সাতসকালে সড়কে ঝরল ৪ প্রাণ

১২

দুপুরের মধ্যে ঢাকাসহ ১২ জেলায় ঝড়ের শঙ্কা 

১৩

স্কুলমাঠে হাট বসানো সেই বিএনপি নেত্রীকে সেনাবাহিনীর তলব

১৪

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সিলিন্ডারবাহী ট্রাকে আগুন, ভয়াবহ বিস্ফোরণ

১৫

০৪ জুন : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৬

০৪ জুন : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৭

দেশে শৃঙ্খলা ফেরাতে দ্রুত নির্বাচন দিন : উবায়দুল্লাহ ফারুক

১৮

গার্মেন্টসকর্মী থেকে প্রেসিডেন্ট

১৯

দাঁড়িয়ে থাকা বাসে মোটরসাইকেলের ধাক্কা, নিহত ২

২০
X