পেশাগত জীবনে অনেকেই দক্ষতার সঙ্গে ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু একজন সত্যিকারের নেতা হয়ে ওঠার পথ আরও জটিল, গভীর এবং বিবর্তনশীল। একটি টিম পরিচালনার মাধ্যমে সাফল্য এনে দেওয়ার পর, পরবর্তী ধাপটি হয় বৃহত্তর পরিসরে নেতৃত্ব দেওয়া- যেখানে দায়িত্বের সঙ্গে পাল্টে যায় দৃষ্টিভঙ্গি, কাজের ধরন এবং সাফল্যের সংজ্ঞা। এটাই সেই পর্যায়, যেখানে একজন ম্যানেজারকে রূপান্তরিত হতে হয় একজন কৌশলী নির্বাহী (এক্সিকিউটিভ) হিসেবে।
২০২৫ সালের জুন মাসে Harvard Business Review-এ প্রকাশিত ‘Navigating the Jump from Manager to Executive’ শীর্ষক প্রবন্ধে এই রূপান্তরের সূক্ষ্ম ও কার্যকর দিকগুলো অনন্যভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সে ভাবনার আলোকে এই লেখাটি আগ্রহী পেশাজীবীদের জন্য একটি অনুপ্রেরণামূলক ও ভাবনাপ্রসূত মনের খোরাক হতে পারে।
নেতৃত্ব মানে শুধু বড় দলে নেতৃত্ব দেওয়া নয়
বহুজন মনে করেন, নির্বাহী পদে উত্তরণ মানেই বড় টিম, বেশি ক্ষমতা এবং অধিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। বাস্তবে এটি শুধুই পদোন্নতি নয়, বরং একটি মানসিক রূপান্তর। এই স্তরে এসে আর শুধু কাজ পরিচালনা করলেই চলে না- এখন আপনাকে গড়তে হয় একটি সংস্কৃতি, দৃষ্টিভঙ্গি ও কাঠামো।
নেতৃত্ব এখন আর নিজ হাতে কাজ করে দেখানোর বিষয় নয়; বরং এমন পরিবেশ তৈরি করার চ্যালেঞ্জ, যেখানে অন্যরা নিজেরাই নেতৃত্ব নিতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং কাজের দায় নিজের কাঁধে নিতে পারে। ‘আমি করি’ চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে এখানে নেতৃত্ব মানে ‘আমরা করি’- এই যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করা।
সমস্যা সমাধান নয়, সহায়ক কোচিং
ম্যানেজার হিসেবে আপনি হয়তো অভ্যস্ত প্রতিটি সমস্যার দ্রুত সমাধান দিতে। কিন্তু সিনিয়র নেতৃত্বের আসনে বসার পর আপনাকে সেই অভ্যাসটি বদলাতে হবে। আপনার মূল ভূমিকা তখন আর সমাধান দেওয়া নয়, বরং এমন প্রশ্ন তোলা, যা অন্যদের চিন্তা করতে এবং সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে।
যেমন : • আপনি এ ব্যাপারে কী ভাবছেন? • এই সিদ্ধান্তের সম্ভাব্য ঝুঁকি কোথায়?” • যদি এটা সফল না হয়, তখন আমরা কী শিখতে পারি?
এই ধরনের কৌশলগত প্রশ্ন একজন ম্যানেজারকে নিজের বিচারবুদ্ধির উপর ভরসা রাখতে শেখায়। মনে রাখতে হবে- নীরবতাও হতে পারে নেতৃত্বের শক্তিশালী মাধ্যম। কখনো কখনো উত্তর না দিয়ে, কেবল সঠিক প্রশ্ন তুলে দেওয়াটাই হয় সবচেয়ে কার্যকর নেতৃত্ব।
নিজ হাতে নয়, অন্যদের মাধ্যমে প্রভাব তৈরি করুন
নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তরের একটি হলো- ‘হ্যান্ডস-অন’ থেকে ‘হ্যান্ডস-অফ’ হয়ে ওঠা। ছোট টিমে সরাসরি কাজ করা সম্ভব হলেও, বৃহৎ পরিসরে আপনাকে অন্যদের কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে।
এখানে আপনার ভূমিকা হয়- সুযোগ তৈরি করা, দিকনির্দেশনা দেওয়া এবং সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করা। আপনি নিজে প্রতিটি কাজ করবেন না; আপনি এমন একটি সিস্টেম গড়ে তুলবেন, যেখানে প্রতিটি সদস্য নিজ নিজ ভূমিকা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পালন করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ : • আজ আপনি যে ফিডব্যাক দিলেন, তা হয়তো আগামী মাসে একটি টিমের উন্নত পারফরম্যান্সে পরিণত হবে। • আপনি যে মেন্টরিং দিচ্ছেন, তা হয়তো পরবর্তী প্রজন্মের নেতাকে গড়ে তুলছে।
নেতৃত্ব মানে এখন আর তাৎক্ষণিক ফল নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব তৈরির দক্ষতা।
সিস্টেম তৈরি করুন, সংকোচ নয়
বহু নতুন নির্বাহী নেতাই মনে করেন- সব কিছু নিজের নজরে রাখা উচিত। কিন্তু এতে আপনি নিজেই হয়ে উঠবেন একটি বটলনেক, অর্থাৎ দলের গতির সবচেয়ে বড় বাধা।
আপনার প্রকৃত দায়িত্ব হলো একটি সুসংগঠিত ও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা তৈরি করা, যাতে আপনি প্রয়োজনীয় জায়গায় সচেতন থাকতে পারেন, কিন্তু প্রতিটি ছোট কাজে জড়াতে না হয়।
এর কিছু উপায় : • ড্যাশবোর্ড : টিমের কাজের অগ্রগতি মনিটর করার সহজ ও স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি। • লিখিত আপডেট : যাতে আপনি নিয়মিত অবহিত থাকেন, কিন্তু অতিরিক্ত মিটিংয়ে জড়াতে না হয়। • এস্কেলেশন ম্যাট্রিক্স : কোন বিষয়ে কখন আপনাকে যুক্ত করা প্রয়োজন, তার সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন।
এই ধরনের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা আপনাকে নেতৃত্বের স্তরে উপযুক্ত করে তোলে- একজন সমন্বয়কারী হিসেবে নয়, বরং একটি দিকনির্দেশক বাতিঘর হিসেবে।
সাফল্যের সংজ্ঞা বদলে ফেলুন
ম্যানেজার হিসেবে সাফল্য ছিল- লক্ষ্য পূরণ, সময়মতো কাজ শেষ করা বা ক্লায়েন্টকে সন্তুষ্ট রাখা। কিন্তু নির্বাহী হিসেবে সাফল্য মানে হলো অন্যদের সাফল্যের পথ তৈরি করে দেওয়া।
আপনার নিজের প্রশ্ন হতে পারে : • আমি কাকে নেতৃত্বে অনুপ্রাণিত করেছি? • আমার সহায়তায় কে নিজেকে ছাড়িয়ে গেছে? • আমি কেমন নেতৃত্ব সংস্কৃতি তৈরি করেছি?
এই মানসিক রূপান্তর একজন নেতাকে করে তোলে আরও মানবিক, দৃষ্টিশীল ও অনুপ্রেরণাদায়ী।
নেতৃত্ব মানে দূরদৃষ্টির সঙ্গে সহানুভূতির সমন্বয়
নেতৃত্ব মানে শুধু কৌশল নয়, এটি একটি ‘মানসিক উপস্থিতি’। আপনি অফিসে না থাকলেও, টিম জানে- আপনি আছেন। আপনি কিছু না বললেও, আপনার দৃষ্টিভঙ্গি সিদ্ধান্তে প্রতিফলিত হয়।
একজন প্রভাবশালী নির্বাহী বোঝেন- • কখন সামনে যেতে হয়, আবার কখন পিছনে থেকে জায়গা করে দিতে হয়। • কখন পরামর্শ দিতে হয়, আবার কখন কাউকে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে দিতে হয়। • কখন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, আবার কখন শুধু শ্রোতা হয়ে থাকা সবচেয়ে বড় সমর্থন।
এই ভারসাম্য আসে আত্মবিশ্বাস, সহানুভূতি ও অভিজ্ঞতার সুনিপুণ সমন্বয়ে।
শেষ কথা - নেতৃত্ব এক নিরবধি অভিযাত্রা
নেতৃত্ব হলো এমন একটি পথ, যার শেষ নেই- শুধু নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে।
ম্যানেজার থেকে নির্বাহী হয়ে ওঠা শুধুই একটি পদোন্নতি নয়- এটি একটি আত্মবিকাশ ও আত্মজাগরণের অভিজ্ঞান।
এখানে প্রয়োজন- • নিজের সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে নেওয়া, • অন্যের ওপর আস্থা রাখা, • এবং সবচেয়ে বড় কথা- নিজের সাফল্যের ছায়ায় অন্যদের সাফল্য দেখে গর্বিত হওয়া।
তাই আপনি যদি এখন একজন ম্যানেজার হয়ে থাকেন, নিজেকে প্রশ্ন করুন— • আমি কি নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত? • আমি কি নিজের আচরণ ও অভ্যাস বদলাতে পারি? • আমি কি অন্যদের সফলতা দেখেই নিজেকে সার্থক মনে করতে পারি?
আপনার উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়- তবে আপনি সেই পথে হাঁটছেন, যেখানে নেতৃত্ব শুধু পদের পরিচয় নয়, বরং অন্তরের পরিচয় এবং অন্যদের সাফল্যই হবে আপনার গর্ব।
লেখক : এমএম মাহবুব হাসান, ব্যাংকার ও উন্নয়ন গবেষক
মন্তব্য করুন