এস এম আজাদ হোসেন
প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ০২:১৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

ওয়ার্ল্ড ডে অব রিমেমব্রান্স: স্মরণ, শোক এবং নিরাপদ ভবিষ্যতের অঙ্গীকার

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

প্রতি বছর নভেম্বর মাসের তৃতীয় রোববার। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য মানুষ এ দিনটিকে পালন করেন ভিন্ন এক আবেগে-শোক, স্মরণ, কৃতজ্ঞতা এবং দায়বদ্ধতার মিশেলে গঠিত এক মানবিক দিনে। ওয়ার্ল্ড ডে অব রিমেমব্রান্স কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়; সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন যারা পরিবার, প্রিয়জন ও স্বপ্ন হারাচ্ছেন—তাদের প্রতি সমবেদনা জানানোর বৈশ্বিক মঞ্চ।

একই সঙ্গে এটি একটি সতর্কবার্তা—আমাদের প্রতিটি শহর, প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি সিগন্যাল এবং প্রতিটি চালকের মনোভাবের ভেতরে কোথাও না কোথাও বড় ধরনের সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা আজ বহুমাত্রিক সংকটের নাম। প্রতিদিনের সংবাদ, হাসপাতালের বেড, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন—সবই আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়, এই দেশ এখনো নিরাপদ সড়কের ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।

শুধু পরিসংখ্যান নয়, প্রতিটি মৃত্যুই একটি গল্প। সেই গল্পে থাকে ভাঙা পরিবার, কান্না, সংগ্রাম, আর ফিরে না আসা কোনো মানুষের ছায়া। আর সে কারণেই এই দিনটি কেবল মৃতদের স্মরণে নয়—বরং আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য গভীর আত্মসমালোচনার সুযোগ।

আমরা অনেক সময় সড়ক দুর্ঘটনাকে কেবল পরিসংখ্যান হিসেবে দেখি—অমুক রুটে অমুক সংখ্যা মারা গেছে, অমুক বেপরোয়া চালকের কারণে অমুক পরিবার নিঃস্ব হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সড়ক দুর্ঘটনা নিছক একটি ঘটনাও নয়, আবার শুধুই প্রযুক্তিগত ব্যর্থতাও নয়। এটি একটি মানবিক বিপর্যয়, যার পেছনে রয়েছে আমাদের আচরণগত ঘাটতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা, অব্যবস্থাপনা, এবং কখনো কখনো আমাদের অসচেতনতা।

ওয়ার্ল্ড ডে অব রিমেমব্রান্স আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রতিটি প্রাণের মূল্য। যারা আজও অপেক্ষা করছেন কোনো প্রিয়জনের হাত ফেরত আসার, তাদের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। এই দিনের প্রতিটি আলোচনায়, প্রতিটি মোমবাতির শিখায়, প্রতিটি নিস্তব্ধ মুহূর্তে আমরা তাদের ব্যথাকে সম্মান জানাই।

কিন্তু স্মরণ যদি কেবল শোকেই সীমাবদ্ধ থাকে-তবে তার কোনো অর্থ নেই। শোককে রূপান্তরিত করতে হবে দায়বদ্ধতায়। যেখানে প্রতিটি নাগরিক, প্রতিটি চালক, প্রতিটি নীতিনির্ধারক নিজের ভূমিকা নিয়ে বিবেচনায় বসবে।

নিরাপদ সড়ক কেবল আইন বা অবকাঠামোর দায় নয়; এটি একটি সংস্কৃতির অংশ। যে সমাজে ট্রাফিক সিগন্যাল মানা হয় না, যেখানে লাইসেন্স ক্রয়ে অনিয়ম রয়েছে, যেখানে যাত্রী ও পথচারী নিজেদের ভুল স্বীকার করতে লজ্জা পায়—সেখানে সড়ক নিরাপত্তা কেবল কাগজে-কলমে সীমিত থাকে।

আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত যানচালক পর্যন্ত—সবারই সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে প্রশিক্ষণের অভাব। এমনকি যারা প্রতিদিন হাজার মানুষের জীবন নিয়ে রাস্তায় নামেন, সেই চালকদের অনেকেই জানেন না মৌলিক ট্রাফিক নিয়ম। এতে বিপদ যেমন বাড়ে, তেমনি বাড়ে মৃত্যুর ঝুঁকি।

তবে এর মানে এই নয় যে পরিবর্তন অসম্ভব। বরং ছোট কিছু পদক্ষেপেই বড় পরিবর্তন আসতে পারে। যেমন— গাড়ি চালানোর আগে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা, নিয়ম অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কড়া ও স্বচ্ছ ব্যবস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সড়ক নিরাপত্তা পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা, গণপরিবহনে ডিজিটাল মনিটরিং, দুর্ঘটনা-পরবর্তী জরুরি সেবার দ্রুততা নিশ্চিত করা।

একটি দায়িত্বশীল সমাজ নিরাপদ সড়ক তৈরির সক্ষমতা রাখে, শুধু দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও নাগরিক সচেতনতা।

অনেক সময় আমরা পুরো দোষটা চাপিয়ে দিই চালকদের ওপর। কিন্তু বাস্তবতা আরও জটিল। অযথা ওভারটেকিং করে যাত্রীদের চাহিদা, দ্রুত বাড়ি পৌঁছানোর অস্থিরতা, পথচারীর অসতর্কতা, রাজনৈতিক-সক্ষমতা নির্ভর পরিবহন ব্যবসা—এসবই একটি বৃহৎ সমস্যার অংশ।

এমনকি আমরা নিজেরাও অনেক সময় ক্ষুদ্র ভুলে বড় বিপর্যয় ডেকে আনি—হাতে মোবাইল নিয়ে রাস্তা পার হওয়া, মোটরসাইকেলে হেলমেট না পরা, গাড়ি চালিয়ে ভিডিও করা, সড়কে হঠাৎ দৌড়ে রাস্তা পার হওয়া-এসব আচরণ জীবননাশী হতে পারে।

এই কারণে ওয়ার্ল্ড ডে অব রিমেমব্রান্স আমাদের ব্যক্তি হিসেবে প্রশ্ন করে—আমরা কি সত্যিই দায়িত্বশীল? আমাদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত কি নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে নেওয়া? সড়কে নামার আগে আমরা কি মনে রাখি—একটি ভুল মানেই হয়তো আর কারও ঘরে আগুন?

আজকের শিশুরা একদিন দেশের নাগরিক, চালক, পথচারী, আইনপ্রণেতা হবে। নিরাপদ সড়কের ধারণাটি যদি তাদের মনোজগতে আজ থেকেই প্রতিষ্ঠিত করা যায়—তবে আগামী বাংলাদেশ হবে ভিন্ন এক বাংলাদেশ। যেখানে সড়ক আর বিপদের প্রতীক হবে না; বরং হবে সুশৃঙ্খল চলাচলের পথ।

ওয়ার্ল্ড ডে অব রিমেমব্রান্স-এর আসল তাৎপর্য এখানেই—এই দিনটি আমাদের শেখায় যে স্মরণ মানেই দায়িত্ব, শোক মানেই পরিবর্তনের অঙ্গীকার।

সড়ক যেন আর কারও জীবনের শেষ ঠিকানা না হয়—এটাই হোক আজকের প্রধান শপথ। যারা আজ নেই, তারা আমাদের অন্তরে চিরস্থায়ী। তাদের স্মৃতি আমাদের শেখায় জীবনের মূল্য, নিরাপত্তার গুরুত্ব এবং ভুলের পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে। তাই আসুন, আজ আমরা নিজেরা বদলাই, সমাজকে বদলাই এবং রাষ্ট্রকে বদলাতে উৎসাহিত করি।

নিরাপদ সড়কের স্বপ্ন আজই বাস্তবায়ন করা সম্ভব, যদি আমরা সবাই মিলে তা চাই—হৃদয় থেকে, দায়িত্ববোধ থেকে, আর মানবিকতার মহান বোধ থেকে।

লেখক- কলামিস্ট, সোস্যাল অ্যাক্টিভিস্ট, মহাসচিব—নিরাপদ সড়ক চাই।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

টি-টেন লিগে দল পেলেন বাংলাদেশের তারকা ক্রিকেটার

ইউরোপ যাত্রা / যে সমুদ্রপথ কেড়ে নেয় হাজারো স্বপ্ন ও জীবন

বাঞ্জি জাম্পিংয়ের দড়ি ছিঁড়ে ১৮০ ফুট উঁচু থেকে পড়ে গেলেন যুবক

গণভোটের আইনি ভিত্তি নেই : রিজভী

নবান্নের পিঠার সুবাসে মুখর রাবি, কৃষি অনুষদে উৎসবের রং

ভয়াবহ ব্যাটিং ধসে সহজ ম্যাচ হেরে বসল ভারত

হাসিনার রায়ের দিন মাঠে থাকার ঘোষণা জামায়াতসহ ৮ দলের

চট্টগ্রাম বোর্ডে এইচএসসিতে ফেল থেকে পাস করলেন ৩৯৩ শিক্ষার্থী

কুমিল্লা বোর্ডে ফল পুনর্নিরীক্ষণে ফেল থেকে পাস ১০৮ শিক্ষার্থী

উইন্ডোজ ১১-এ আসছে নতুন ফিচার

১০

মেহজাবীনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

১১

নাশকতার মামলায় আ.লীগের ৭ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার

১২

গোপালগঞ্জে আ.লীগের নাশকতা ঠেকাতে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচি

১৩

ঢাকাসহ ৪ জেলায় বিজিবি মোতায়েন

১৪

ওয়ার্ল্ড ডে অব রিমেমব্রান্স: স্মরণ, শোক এবং নিরাপদ ভবিষ্যতের অঙ্গীকার

১৫

গোমতী নদীর চরে গলায় কাপড় প্যাঁচানো কিশোরের মরদেহ

১৬

কেউ শোনে না চরাঞ্চলের শিক্ষকদের চাপা কান্না

১৭

ঘরেই বানিয়ে নিন সরষে-পোস্তো দিয়ে কাতলা মাছের ঝাল

১৮

স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভিপি পদে মনোনয়ন নিলেন জবি ছাত্রদল নেতা

১৯

মুগ্ধতায় নুসরাত ফারিয়া

২০
X