অজিত কুমার সরকার
প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৩, ০৮:৫৫ পিএম
আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০২৩, ০৯:০৪ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

শেখ রাসেল হত্যা : বিশ্ব বিবেক ও মানবতা যেখানে পরাজিত

বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেল। সৌজন্য ছবি
বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেল। সৌজন্য ছবি

মানবতা যখন পরাজিত হয়- বোঝাই যায় তার সাথে যুক্ত ঘটনাগুলো কতটা ভয়াবহ ও নৃশংস হতে পারে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পরিবারের সদস্যদের সাথে নিষ্পাপ শিশু শেখ রাসেলকে নির্মমভাবে হত্যা করে ঘাতকরা। ছোট্ট রাসেল মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিল। মৃত্যুর বিভীষিকা দেখে ভয়ার্ত রাসেলের এই আবেদনের মধ্যে বাঁচার আকুতি ছিল প্রবল। কিন্তু নিষ্ঠুর ঘাতকরা তার সে আবেদনে সাড়া দেয়নি। বাবা, মা, ভাই, ভাবি ও স্বজনের লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে তাকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। তাদের পাশেই পড়ে থাকে রাসেলের নিথর দেহ। বুলেটে বিদ্ধ করা হয় মানবতাকে। বিশ্ব ইতিহাসে যোগ হয় মানবতার এক ভয়ঙ্কর পরাজয়। দেশি-বিদেশি চক্রান্তে ১৫ আগস্টের এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বিশ্বের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় কোথায় তোমাদের মানবতাবোধ? যেখানে নির্মল, প্রাণবন্ত ছোট্ট শিশু রাসেলকেও ঘাতকরা রেহাই দেয় না! যেখানে এমন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড সংঘটনের ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে বিদেশি কোনো কোনো রাষ্ট্রের।

প্রসঙ্গত শিশুর নিথর দেহ পড়ে থাকা নিয়ে ভিন্ন একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। মানবতার পরাজয়ে বিশ্ব বিবেকের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন তুরস্কের ফারাহ খাতাব নামে এক ব্যক্তি। দেশটির দাগন সংবাদ সংস্থার চিত্র সাংবাদিক নিলুফার ডেমি ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে তুরস্কের সাগর উপকূলে পড়ে থাকা তিন বছরের শিশু আয়নাল কুর্দির নিথর দেহের ছবিটি তোলার পর ওই দিনই ফারাহ খাতাব ছবিটিতে #Kiyiya VuranInsanlik (Humanity Washed Ashore) অর্থাৎ ‘মানবতা ভেসে গেল সাগর তীরে’ হ্যাশট্যাগসহ টুইট করেন। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচার জন্য স্বজনের সাথে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকা ডুবে মারা যাওয়া শিশু আয়নালের মৃত্যু নিয়ে ফারাহ খাতাব তাবৎ বিশ্বের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে লিখেছিলেন, ‘কোথায় তোমাদের বিবেক, কোথায় তোমাদের মানবতাবোধ’? আসলে রাজনৈতিক কারণে শিশু হত্যা কিংবা যুদ্ধের কারণে প্রাণ বাচাঁতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা মানবতার ধ্বজাধারীদের কতটা নাড়া দেয় তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এর প্রধানতম কারণটি হচ্ছে রাজনৈতিক স্বার্থের হিসাব নিকাশ। তাই নির্মমতার বিরুদ্ধে কখনও কখনও তাদের প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের ফাঁদে আটকে থাকে। কী অপরাধ ছিল রাসেলের? মাত্র ১০ বছর বয়স। তখনতো ওর রাজনীতি করার বয়স হয়নি। খেলাধুলা, লেখাপড়া আর মা, ভাইবোনদের কাছে মনের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেই আনন্দ পেত সে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিশু কাব্যগ্রন্থে মায়ের সঙ্গে শিশুর খেলা, মায়ের কাছে মনের কথা বলা ও ইচ্ছার প্রকাশ তুলে ধরেছেন এভাবে- ‘মাগো আমায় ছুটি দিতে বল/ সকাল থেকে পড়ছি যে মেলা।/এখন আমি তোমার ঘরে বসে/ করব শুধু পড়া-পড়া খেলা।’ কবিগুরুর এ কবিতার মতোই রাসেল মায়ের কাছে তার মনের ইচ্ছা প্রকাশ করতো। পিতা রাজনীতির কারণে বাইরে অথবা কারাগারে থাকার কারণে মায়ের সাথেই সবচেয়ে বেশি সময় কেটেছে রাসেলের। মনের কথার প্রকাশও করেছে সবচেয়ে বেশি। নানা প্রশ্নের উত্তরও দিতে হয়েছে মাকেই। খেলার প্রতি রাসেলের তীব্র আকর্ষণ ছিল। তবে সাইকেল চালানো ছিল তার নিত্যদিনের একটি অভ্যাস। যদিও এ নিয়ে মা থাকতেন উদ্বিগ্ন। প্রয়াত সিনিয়র সাংবাদিক এ বি এম মূসার ‘মুজিব ভাই’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা- ৪০-৪১) লিখেছেন, ‘এদিকে ৩২ নম্বরের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন স্নেহময়ী মা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন দুষ্টু ছেলেটার সাইকেল পরিক্রমা যেন নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে। অন্যদিকে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শুনে বারন্দায় এসে দাঁড়াতেন হাসিনা। ওপর থেকে উচ্চ স্বরে সাবধানবাণী ভেসে আসত, ওরে দুষ্টু, মিরপুর রোডে যাবি না।’

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, শিশুরাই সবচেয়ে নির্মল, মানবিক ও সৃজনশীল। মানুষের দ্রুততম বিকাশ হয় শৈশবের শুরুতে, জন্মের পর থেকে আট বছর বয়স পর্যন্ত থাকে বিকাশের এই পর্ব। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে জন্ম নেওয়া রাসেল মানসিক বিকাশের এই পর্বে নিজ চোখে দেখেছেন তাদের বাড়িটি কীভাবে রাজনীতি, মানবতা ও মানুষের প্রতি ভালবাসার অনন্তবাসে পরিণত হয়। প্রায় প্রতিদিনই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজারো মানুষের আনাগোনায় মুখরিত থাকতো বাড়িটি। রাসেল দেখেছেন মা-বাবা মানুষকে কতোটা ভালোবাসতেন। মনুষ্যত্বের শিক্ষা রাসেল পেয়েছে ঘর থেকেই। এরপর শিক্ষকের কাছ থেকে। মানব সভ্যতায় শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যেকার সম্পর্কের ঐতিহ্যময় ইতিহাস রয়েছে। একজন সফল মানুষের পেছনে শিক্ষকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বাসার গৃহ শিক্ষক গীতালি দাশগুপ্তাও সেই ভূমিকাই পালন করেছেন। মা-বা-সন্তানের সম্পর্কের মতোই অভিভাবকত্ব ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলে রাসেলকে ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। বয়স কম হলেও তার মধ্যে দার্শনিক ভাব পরিলক্ষিত হয়। দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে ওর নাম রাখা হয়। ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ নিবন্ধে শেখ হাসিনা লিখেছেন,‘আব্বা বার্ট্রান্ড রাসেলের খুব ভক্ত ছিলেন, রাসেলের বই পড়ে মাকে ব্যাখ্যা করে শোনাতেন। মা রাসেলের ফিলোসফি শুনে শুনে এত ভক্ত হয়ে যান যে নিজের ছোট সন্তানের নাম রাসেল রাখলেন।’

রাসেলের মধ্যে দার্শনিক ভাব সম্পর্কে ১৭ অক্টোবর, ২০২২ বার্তা সংস্থা বাসস এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে গীতালি দাশগুপ্তা বলেন, ‘বয়সে ছোট হলেও শেখ রাসেলের হৃদয়টা ছিল অনেক বড় ও উদার। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের প্রতি ছিল তার প্রগাঢ় ভালোবাসা। শিশু বয়সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর মানসিকতা ছিল তার মধ্যে। তার শিশু সুলভ সমস্ত আচরণ বা কর্মকাণ্ডের মধ্যে কেবলই সরলতা নয়, আদর্শিক ও দার্শনিক একটা ভাবও ছিল। এমনকি কোনো বিষয়ে কঠিন অবস্থানে থাকলেও যুক্তি দিয়ে তাকে বশ করানো যেত।’ গীতালি রাসেলকে শুনিয়েছিলেন অহিংস, ন্যায় ও সাম্যনীতির বলিষ্ঠ কণ্ঠ মহামতি গৌতম বুদ্ধের জীবনকথা ও তার অমিয় বাণী- ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’। আর সে কারণেই পিতাকে অনেক রাতে বাড়িতে ফিরে রাসেলের শিশু মনের প্রশ্ন- ‘তুমিও কি গৌতম বুদ্ধের মতো হতে পার না’ শুনতে হয়েছে। দরিদ্র মানুষের কান্নায় রাসেল ব্যথিত হতো। বাসার কাছের একটি বাড়িতে রাসেল নামের আরেকটি শিশুর সাথে খেলতো সে।

একদিন শীতের দিনে পাশের বাসার সামনে কাজের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত ১ টাকার স্থলে চার আনা পেয়ে কান্নারত দরিদ্র নারীর ন্যায্য পাওনা নিশ্চিতে পিতার বাড়ি আসা অব্ধি তাকে অপেক্ষা করতে বলেছিল। শুধু তাই নয় তাকে বসিয়ে রেখে খাবারও খাইয়েছিল। দশ বছর বয়সে রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। স্কুলের সহপাঠীদের প্রতিও ছিল সহমর্মিতা ও ভালোবাসা। বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া চকলেট, টিফিন তাদের সাথে ভাগ করে খেত। টুঙ্গিপাড়ায় গেলে খেলার সাথীদের ডামি বন্দুক বানিয়ে দিয়ে সেই বন্দুক হাতে তাদের প্যারেড করাতো। তাদের প্রত্যেকের জন্য খাবার কিনে দিত।

লেখার শুরুটা করেছিলাম মানবতার পরাজয় নিয়ে। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা দুরন্ত ছোট্ট রাসেলতো মানবিকবোধসম্পন্ন হৃদয়বান মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠছিল। একজন মানুষের মধ্যে যতগুলো ভালো গুণ ও সুন্দরের অনুভূতি থাকে তার সবইতো ছিল তার মধ্যে। কিন্তু হায়েনারা তাকে বাচতে দিল না। দুর্ভাগ্যজনক হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের মতো ঘৃণ্য ঘটনার প্রতিবাদে সে সময় আন্তর্জাতিক বিশ্বকে সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। মানবতার পরাজয়ের এমন দুর্মর মুহূর্তে প্রকাশ্য হয়ে উঠে তাদের মেরুকরণের রাজনীতি ও কূটনীতির ঊর্ণনাভজালিকা। এ হেন জঘন্য হত্যাকাণ্ডের ৪১ দিন পর খুনি মোশতাক বিচার বন্ধে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। আর জিয়া ৯ জুলাই ১৯৭৯ জাতীয় সংসদে খুনিদের রক্ষায় ইনডেমনিটি আইনের বৈধতা দেয়। বিশ্বের কোনো দেশতো এর বিরুদ্ধে কথা বলেনি। মানবাধিকার নিয়ে যারা বড় কথা বলে তাদের ভূমিকা আজও প্রশ্নবিদ্ধ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কাপুরুষোচিত হত্যাকাণ্ডকে বীরত্বব্যাঞ্জক ভাষায় কৃতিত্বের দাবি করা খুনিদের কয়েকটি দেশ রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়। এমনকি যে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা নিজেদের মানবাধিকারের রক্ষাকবচ হিসেবে দাবি করে সেখানে আজও খুনিরা নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছে। বিশ্ব বিবেক ও মানবতা এখানেই পরাজিত। অজিত কুমার সরকার : সিনিয়র সাংবাদিক

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এক লাখ শ্রমিক নেওয়ার পরিকল্পনা জাপানের : প্রেস সচিব

কুবিতে সাংবাদিকদের ওপর ছাত্রদলের একাংশের হামলার অভিযোগ

মগবাজারের সেই ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৩ জন গ্রেপ্তার

বিসিবি সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগের বিষয়ে যা বললেন ফারুক

ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে কে কত ভুয়া তথ্য ছড়িয়েছে

ইশরাকের মেয়র পদ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচন কমিশন : আপিল বিভাগ

গারো পাহাড়ে বুবলীর শুটিং, প্রতিবাদ জয়ার 

৩৩ বার পেছাল জিকে শামীমের জামিন শুনানি 

কালবেলায় সংবাদ প্রকাশ, বিএমইটিতে অভিযান চালাচ্ছে দুদক

ঝালকাঠিতে ভারি বৃষ্টিপাত, বেড়েছে ভোগান্তি

১০

ফ্রিতে ২ লাখ টাকার প্রশিক্ষণ শেষে চাকরির সুযোগ, আবেদন করবেন যেভাবে

১১

সাগরে নিম্নচাপটি কোন বন্দর থেকে কত দূরে

১২

দলীয় নেতাকর্মীদের কঠোর বার্তা দিলেন জামায়াত আমির

১৩

আশুলিয়ায় হা-মীম গ্রুপের পোশাক কারখানায় আগুন

১৪

মেসি-সুয়ারেজ ঝলকে জয়ে ফিরল ইন্টার মায়ামি

১৫

সাগরে নিম্নচাপ, অভ্যন্তরীণ যেসব নৌরুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ

১৬

রাণীশংকৈলে বিএনপি নেতা আইনুল হকের জানাজা সম্পন্ন 

১৭

সন্ধ্যার মধ্যে ঢাকাসহ ৯ জেলায় ৮০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা

১৮

বিসিবি সভাপতির পদ ছাড়ছেন ফারুক!

১৯

আ.লীগ নেতার বাড়িতে ছয়জনের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, গ্রেপ্তার ৬

২০
X