ঢাকার সাভার উপজেলার ভাগলপুরে ধলেশ্বরী নদীর বুকে গড়ে উঠেছে শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম। নদীর তীর ঘেঁষে নয়, সরাসরি নদীর বুকে নির্মিত এই স্টেডিয়াম ঘিরে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। সরকারি হিসাব বলছে, নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ২ একর ৬ শতক খাসজমি, অথচ বাস্তবে নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ৩ একর জায়গাজুড়ে—যার মধ্যে ৯৪ শতকই ধলেশ্বরী নদীর জায়গা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, স্টেডিয়ামের পাশে গড়ে উঠেছে স্থাপনা, ভরাট করা হয়েছে নদীর পাড়। স্টেডিয়াম সংলগ্ন একটি এলাকায় যেখানে বর্ষায় নৌকা ভিড়ত, সেখানেই এখন বালু ফেলে বসানো হয়েছে দোকান। স্থানীয়দের অভিযোগ, নদীর জায়গা দখল করে শেখ রাসেলের নামে মিনি স্টেডিয়াম গড়ে তোলায় এলাকাবাসীও নদী দখলে উৎসাহ পাচ্ছেন।
সত্তরোর্ধ্ব স্থানীয় বাসিন্দা সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি এই জায়গাটি নদীর অংশ। এখন এখানে প্রাচীর ঘেরা স্টেডিয়াম। পাশেই নদীর জায়গা দখল করে দোকান বানানো হয়েছে। এছাড়া বানানো হয়েছে বালুর বেশকয়েকটি গদি।’
সরকারি প্রকল্প, কিন্তু নিয়মবহির্ভূত
প্রাপ্ত নথি অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ১৫ এপ্রিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় ‘কাবিটা-কাবিখা’ প্রকল্পের মাধ্যমে এই স্টেডিয়ামের নির্মাণ শুরু হয়। বরাদ্দ ছিল প্রায় ৪০ লাখ টাকা এবং ২৫০ মেট্রিক টন চাল। পরে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পক্ষ থেকেও আরও ৪১ লাখ টাকার অবকাঠামো নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়।
তবে সাভার উপজেলা ভূমি অফিস জানায়, এখন পর্যন্ত স্টেডিয়ামের জমি বরাদ্দের কোনো কাগজ নেই। ভূমি মন্ত্রণালয় ২০২২ সালে ঢাকা জেলা প্রশাসককে বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দিলেও তা কার্যকর হয়নি। জমির সিএস রেকর্ডে জায়গাটি ধলেশ্বরী নদীর অংশ হিসেবে চিহ্নিত। অর্থাৎ জমি বরাদ্দ ছাড়াই নদীর জমিতে গড়ে উঠেছে সরকারি স্থাপনা।
আদালতের নির্দেশ অমান্য
বংশী-ধলেশ্বরীর দখল ও দূষণ ঠেকাতে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে উচ্চ আদালত ৬টি সরকারি দপ্তরকে দখলদারদের তালিকা দিতে নির্দেশ দিয়েছিল। পাশাপাশি আদালত নদীতে বর্জ্য ফেলা বন্ধ ও নদীর অংশে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনাগুলো অপসারণের নির্দেশও দেয়। কিন্তু এখনো বাস্তবায়ন হয়নি কোনো পদক্ষেপ।
বেলা (বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি) বলছে, আদালতের নির্দেশনার পরও নদীতে বর্জ্য ফেলা এবং দখল চলছেই। স্টেডিয়াম ঘিরে নদীর অস্তিত্বই এখন সংকটাপন্ন।
প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবুবকর সরকার বলেন, ‘আমরা আমাদের আওতাধীন কাজগুলো বাস্তবায়ন করছি। তবে নদী রক্ষায় বিআইডব্লিউটিএ, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।’
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আবুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এব্যাপারে খোঁজ নিতে একটি টিম সরেজমিনে পাঠানো হবে।’
নদী হারিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের মোড়কে
নদী ও পরিবেশ উন্নয়ন পরিষদ সাভারের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ শামসুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘শেখ রাসেল স্টেডিয়াম যেন নদীর জায়গায় না হয়—তা বারবার বলেছি, চিঠিও দিয়েছি। কিন্তু কেউ কর্ণপাত করেনি।’
তিনি আরও জানান, ‘সাভারের বিভিন্ন নদী ও খালবিল দখল করে গড়ে উঠেছে শিল্পপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, আবাসিক প্রকল্প। প্রশাসনের কিছু অভিযান হলেও পুনর্দখল থামছে না। এখন আবার সরকারই নদী দখলে নামছে।’
উন্নয়নের নামে নদী দখল বন্ধ না হলে অচিরেই বংশী ও ধলেশ্বরী মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার। আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে রাষ্ট্রীয় অর্থে যদি নদী দখল বৈধ হয়—তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরিবেশ রক্ষা শুধু কাগুজে প্রতিশ্রুতি হয়েই থেকে যাবে।
মন্তব্য করুন