একাত্তরের দুঃখের দিনগুলোতে আমাদের পরিবারের আশ্রয় হয়নি নিকট আত্মীয়দের বাড়িতে। পিতা-পুত্র মুক্তিযোদ্ধা তাদের আশ্রয় দেওয়ার কারণে যদি বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। মা বাধ্য হয়ে আমাদের নিয়ে রাজারহাটের বরুয়াপাড়ার পঞ্চানন ও প্রেমানন্দ কাকার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
মা গেরিলা যোদ্ধার মতো শেষ পর্যন্ত সেখানেই আমাদের আগলে রেখেছিলেন । মা মুড়িমুড়কি ভাজতেন (একবার মুড়কি বানাতে গরম গুড়ে হাত পুড়িয়ে ফেলেন) সেগুলো আমি চাইনিচ ভাই রাজারহাট পাঙ্গা সড়কের পাশে পান-বিড়ির খোলা দোকানে মাঝেমধ্যে দোকানদারি করতাম । ওই রাস্তা দিয়ে হাজার হাজার শরণার্থী ধরলা নদী পাড়ি দিয়ে ভারতে গিয়েছেন। ওরাই আমাদের খদ্দের ছিলেন। ছোট ভাইজেন ওমর ফারুক বৈদ্যের বাজারে চায়ের দোকান খুলেছিলেন।
মূলত তার দোকান দিয়ে আমরা একাত্তরে জীবনধারণ করেছিলাম। আমরাই অন্নকষ্টে এর মধ্যে আমাদের পিতা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মহিউদ্দিন আহমেদ কুকুর শৃগালের হাত থেকে একটা ঘা পাচরায় বোঝাই মানব শিশুকে নিয়ে এসে মায়ের হাতে তুলে দিলেন । শিশুটি ‘হ’ শব্দ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারত না। মা শুশ্রূষা করে ওকে ভালো করে তোলেন। বয়সে ও আমার ছোটভাই লেনিনের চেয়ে কিছুটা ছোট্ট ছিল। দুজনেই একসঙ্গে খেলেছে। আমরা আজও ওর বাবা মা কে জানি না। ও এখনো খুঁজে, আমরাও খুঁজি কিন্তু আজও সব অজানা রয়েছে।
ওর কোন কুলে জন্ম সেটাও অজানা রয়েছে। আমরা গরু খাই, নামাজ পড়ি বলে হয়তো সেও মুসলমান। আসলে ওর কুলবিভ্রাট সমাধান হয় নেই। একদিন লেনিন স্কুলে ভর্তি হতে গেল সঙ্গে সেও। স্কুলে ভর্তিতে পিতার নাম লাগে। কিশলয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইদুর রহমান আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন মামা ওর বাবার নাম কি? তিনি বললেন, ওর বাবার নাম কোথায় পাব! তিনি বললেন, ওর নাম লিখে দাও এস এম আলমাহমুদ সজিব, বাবার ঘরে আমার নাম লিখে দাও। তখন চুয়াত্তর সাল। এর বছর দুকয়েক পর বাবা গত হলে মা আমাদের সকলকে আগলে ধরে ভাইদের সহযোগিতায় এগিয়ে নেন। ও গ্র্যাজুয়েট হয়েছে। মা বিয়ে দিয়েছেন একটা গুণবতী কন্যা আছে । যার নাম আঁচল। মা তার জীবদ্দশায় আমাদের পৈতৃক সম্পত্তিতে লিখিত দলিলে ওকে সমান অংশ দিয়েছেন।
ও এখনো শেকড়ের সন্ধান করে। জন্মদাতাকে খোঁজে। স্বাধীনতার বায়ান্ন বছরেও ওর নীরব কান্নার শেষ হয়নি। জানি হয়তো শেষ হবেও না।
রাষ্ট্রের ওর জন্য কি কিছু বলার আছে?
রাষ্ট্রের কাছে ওর পরিচয় কী? রাষ্ট্র কি অভিধা দেবে ওকে।
রাষ্ট্র কী করবে জানি না। আমি গর্বিত, আমার মা আমেনা খাতুনের ভূমিকায়। তার এবং তার জ্যেষ্ঠ সন্তানরা এই মানবশিশুকে শুধু লালন করেননি, তাকে সমাজ সংসারে নিজেদের পরিচয়ে বড় করেছেন। সম্পদে সমহিস্যা দিয়েছেন । লেখক: আব্রাহাম লিংকন, একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য আইনজীবী
মন্তব্য করুন