ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে সরকার শপথ না পড়ালে ঢাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই শপথ পড়ে মেয়রের চেয়ারে বসবেন বলে সরকারকে শেষ বার্তা দিয়েছেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন। তিনি বলেছেন, ‘বহিরাগত কোনো প্রশাসক, উপদেষ্টাকে নগর ভবনে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না, প্রয়োজনে প্রত্যেক ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে প্রশাসক বসানো হবে, এটা শেষ কথা।’
মঙ্গলবার (৩ জুন) বিকাল তিনটায় নগর ভবনের প্রধান ফটকের নিচে মঞ্চ তৈরি করে আন্দোলনে অংশ নেওয়া সমর্থকদের মাঝে উপস্থিত হয়ে এসব কথা বলেন ইশরাক।
তিনি বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং তার কতিপয় উপদেষ্টা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে আমাদের এই নির্বাচনের রায়ের পরে টালবাহানা করেছে। আমাকে শপথ না পড়ানোর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানকে লঙ্ঘন করেছে, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতাকে তারা অসম্মান করেছে। তারা আইন-আদালত মানে না, তারা নির্বাচন কমিশন মানে না। তারা সংবিধান মানে না, তাহলে তারা মানেটা কি? এই বাংলাদেশের মানুষ, আমরা যদি আগামীকাল থেকে তাদের না মানা শুরু করি, তাহলে এর দায়-দায়িত্ব কে নেবে।’
ইশরাক বলেন, ‘এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বসানো হয়েছে একটি ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল এবং সর্ব শ্রেণি-পেশার মানুষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। তারা চেয়েছিল যাতে তারা শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। কিন্তু আমরা লক্ষ করলাম, ঢাকা দক্ষিণ সিটির একজন মেয়র খুবই সামান্য পদ যদি আমরা পুরো বাংলাদেশের প্রশাসন এবং স্থানীয় সরকারকে আমলে নিতে চাই। সেটিকে হস্তান্তর করতে আদালতের সর্বোচ্চ রায়ের পরও শপথ পড়ানো নিয়ে টালবাহানা করছে, কীভাবে তাদের অধীনে আগামী দিনে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে সেটা নিয়ে জনগণের মাঝে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এর মাধ্যমে এই সরকার তার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে।’
আন্দোলন ঠেকাতে সরকার পদত্যাগের নাটক মঞ্চস্থ করেছে দাবি করে বিএনপি নেতা ইশরাক বলেন, ‘আদালতের রায় এবং গেজেট প্রকাশের পর আমরা যখন বারবার সরকারের কাছে আবেদন লিখিতভাবে জানালাম, তারা কিন্তু তোয়াক্কা করল না। এরপর ঢাকা দক্ষিণের ভোটাররা রাজপথে নেমে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। আমরা আমাদের দাবি আদায়ে এখান থেকে বের হয়ে যমুনা ঘেরাও দিয়ে দুই দিন অবস্থান করেছিলাম। তখন আমরা কি দেখতে পেলাম, জাতির সামনে একটা নতুন নাটক মঞ্চস্থ করা হলো। যেখানে পদত্যাগের নাটকের মাধ্যমে জাতিকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে একটা নাটক মঞ্চস্থ করা হলো। রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো আবেগের বিষয় নেই। এখানে ১৮ কোটি মানুষের জীবনযাত্রায় জীবিকা নির্বাহের বিষয়। আবেগ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায় না। যখন ইচ্ছা নিলাম, যখন আমি বেজার হলাম তখন পদত্যাগ করে চলে গেলাম- এ ধরনের কর্মকাণ্ড জনগণের কল্যাণময় কিছু হবে না।’
ইশরাক বলেন, ‘এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করতে পারবে এটা শুধু প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি, জনগণের কাছে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বর্তমান সরকার দিয়ে সেটি অর্জন করা কোনোভাবে সম্ভব নয়। আমাদের দলের পক্ষ থেকে তিনজন উপদেষ্টার নাম বলে আসা হয়েছে- অবিলম্বে তাদের পদত্যাগ চাই। যারা দেশ ও জাতির জন্য হুমকিস্বরূপ, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত তাদের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখতে পাইনি।’
সরকার অবিলম্বে শপথ না পড়ালে ঢাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে শহীদ মিনারে নিজের শপথ নিজেই পড়ে চেয়ারে বসার ঘোষণা দিয়ে ইশরাক হোসেন বলেন, ‘ইতোপূর্বে যখন আমরা যমুনা ঘেরাও করেছিলাম তখন কি হলো, নাটক মঞ্চস্থ করার পরে বলা হলো- এটার একটা সমাধান হবে। আমরা জনদুর্ভোগের কথা চিন্তা করে নিজের সিদ্ধান্তে রাস্তা ছেড়ে দিয়েছিলাম, কারও নির্দেশনায় নয়। আমরা ভেবেছিলাম সরকার সুরাহা করবে। পরবর্তীতে আমরা দেখতে পেলাম টালবাহানার মাধ্যমে তাদের যে মুখোশ সেটিকে উন্মোচিত করা হয়েছে।’
ইশরাক বলেন, ‘এই নগর ভবন দুই সপ্তাহ যাবত আমরাই নিয়ন্ত্রণে রেখেছি, আমরাই দখল করে রেখেছি। এই শপথ যদি তারা না পড়ায়, আমি গিয়ে আমার চেয়ারে বসতে পারি, দুই মিনিটও লাগবে না। ঢাকা শহরের জনগণ আমাকে বারবার বলেছে কেন আমি শহীদ মিনারে গিয়ে শপথ পড়ে নিজেই দায়িত্ব নিচ্ছি না। তখন আমি বলেছি, যেহেতু আমরা একটা নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল করি, আমাদের দলের পক্ষ থেকেও নেতারা বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করেছে। বারবার নির্বাচন কমিশন মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হয়েছে। কারণ আমরা নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনায় বিশ্বাসী। আমরা চাই না, একটা বাজে উদাহরণ সৃষ্টি হোক। কিন্তু এই সরকারকে বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে, আপনারা যদি অবিলম্বে শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা না করেন, তাহলে ঢাকা শহর দক্ষিণের ভোটারদের সাথে নিয়ে আমি নিজেই শপথ পড়ে চেয়ারে বসব।’
সরকারের কোনো উপদেষ্টা, স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তা ও প্রশাসক কাউকে নগরভবনে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিএনপি নেতা ইশরাক।
সচিবালয়ে আগুন লাগার কারণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ বেশ কিছু মন্ত্রণালয় পুড়ে যাওয়ার পর থেকে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বসছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। উপদেষ্টাসহ স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তারাও নিয়মিত অফিস করে আসছিলেন নগরভবনে।
সেই প্রসঙ্গ তুলে ধরে ইশরাক হোসেন বলেন, ‘নগর ভবন কীভাবে চলবে, সেটা ঢাকাবাসী নির্ধারণ করবে। কোনো বহিরাগত উপদেষ্টা বা বহিরাগত কোনো প্রশাসক দিয়ে এই নগর ভবন পরিচালনা করতে দেওয়া হবে না, হবে না। এটাই আমাদের শেষ কথা, শেষ বার্তা। আমি স্পষ্ট ঘোষণা দিতে চাই, কোনো বহিরাগত প্রশাসক, কোনো বহিরাগত উপদেষ্টা, কাউকে এই নগর ভবনে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।
ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক বলেন, ‘এটা আমাদের সিদ্ধান্ত, এটা বাস্তবায়নের জন্য নগর ভবনের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, নির্বাচিত কাউন্সিলর ও ঢাকার ভোটারদের বলছি। আমাদের নির্দেশনা ছাড়া বহিরাগত কাউকে এখানে বসতে দেব না, যা কিছু করতে হবে আমাদের অনুমতি নিয়ে করতে হবে। প্রয়োজনে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে আমরা প্রশাসক বসাবো। যতদিন পর্যন্ত আগামী নির্বাচন হচ্ছে না, ততদিন পর্যন্ত সব কার্যক্রমের অধিকার আমাদের কাছেই আছে। এটাই আমাদের বার্তা, এটাই আমাদের শেষ কথা।’
ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে নগর ভবন ঘেরাও ও অবস্থান কর্মসূচি শিথিল করার ঘোষণা দিয়েছেন ইশরাক হোসেন। শপথ পড়ানোর দাবিতে প্রায় ২১ দিন ধরে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে আন্দোলন করে যাচ্ছেন ইশরাক সমর্থকরা।
তিনি বলেন, ‘সামনে ঈদ, জনগণের ভোগান্তি ও জনগণের যাতায়াতের কথা মাথায় রেখে, আমরা বর্তমান নগর ভবনের অবরোধ এবং ঘেরাওয়ের কর্মসূচি কিছুটা শিথিল, কিছুটা বিরতি দিয়েছি। পরবর্তীতে ছুটির পরে, শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা না এলে ঢাকা দক্ষিণের সর্বস্তরের জনগণকে সামনে নিয়ে দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে ঢাকাবাসীর ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করব। যে ভোগান্তি সৃষ্টি হয়েছে, জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে এর পুরো দায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এবং বর্তমান স্থানীয় সরকারের উপদেষ্টা এবং স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তাদের ওপর বর্তায়। তারা সরাসরি সংবিধান লঙ্ঘনের মাধ্যমে আইনকে অবজ্ঞা করেছে, সর্বোচ্চ আদালতকে অবমাননা করেছে। এই আন্দোলন চূড়ান্তভাবে না যাওয়া পর্যন্ত মাঠ ছেড়ে যাব না।’
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচন। তাতে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসকে। ওই নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে ফলাফল বাতিল চেয়ে ২০২০ সালের ৩ মার্চ মামলা করেন ইশরাক হোসেন। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর গেল ২৭ মার্চ ঢাকার নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল সে ফল বাতিল করে ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে। এরপর ২৭ এপ্রিল ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু তাকে যেন শপথ পড়ানো না হয় সেজন্য গত ১৪ মে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মামুনুর রশিদ। অন্যদিকে ইশরাককে শপথ পড়ানোর দাবিতে ওইদিনই আন্দোলন শুরু করেন তার সমর্থকরা। তাদের আন্দোলনে দুই সপ্তাহ ধরে কার্যত অচল হয়ে আছে নগর ভবন।
আইনি জটিলতার কথা বলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এখনো ইশরাককে শপথ পড়ানোর আয়োজন করেনি। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়ার পদত্যাগ দাবি করেন ইশরাক। তার সমর্থকদের আন্দোলনের মধ্যে ‘শপথ না দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে’ দায়ের করা রিট আবেদনটি ২২ মে সরাসরি খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরী ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই আদেশ দেন। রিটকারীর এ ধরনের রিট করার এখতিয়ার না থাকার যুক্তিতে আবেদনটি খারিজ করেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে গত সোমবার আপিল বিভাগে আবেদন করেন রিটকারী আইনজীবী মামুনুর রশিদ। আবেদনে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চাওয়া হয়। সেই লিভ টু আপিলের শুনানি করে আপিল বিভাগ বৃহস্পতিবার বিষয়টি পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে দেন। এই জটিলতায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, নির্বাচন কমিশন এক্ষেত্রে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেনি। কিন্তু তাতে ধোঁয়াশা কাটেনি, ইশরাক হোসেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বসার সুযোগ পাবেন কি না, তা স্পষ্ট হয়নি।
ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট জারির জন্য নির্বাচন কমিশন মন্ত্রণালয়ের কাছে যে মতামত চেয়েছিল, তা নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেছেন সর্বোচ্চ আদালত। আপিল বিভাগ বলেছেন, সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা দিয়েছে। সে ক্ষমতা প্রয়োগ না করে নির্বাচন কমিশন আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছে। অথচ সংবিধান অনুযায়ী উল্টো নির্বাচন কমিশনকে সাহায্য করার কথা মন্ত্রণালয়ের।
মন্তব্য করুন