বাংলাদেশে প্রবাসীদের মৃত্যুর মিছিল ক্রমেই বাড়ছে। পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, উল্লেখযোগ্য প্রবাসী কর্মীর মৃত্যুর কারণ হৃদরোগ। প্রবাসী কর্মীদের মানসিক চাপ, হতাশা, সম্পর্কের টানাপড়েন, অনিয়মিত ঘুম ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়মিত না করাকে বিশেষভাবে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য মতে, গত বছর (২০২৪ সালে) বিভিন্ন দেশ থেকে ৪ হাজার ৮১৩ প্রবাসী কর্মীর মরদেহ দেশে পাঠানো হয়েছে। কেবল সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে গত বছরের ১ জুলাই ২০২৪ থেকে ৩০ জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত মোট ৭০৪ প্রবাসী কর্মীর মরদেহ বাংলাদেশে গেছে। একই সময়ে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত গত আট মাসে ৩ হাজার ৩৭৫ রেমিট্যান্স যোদ্ধার লাশ পাঠানো হয়েছে দেশে। হিসাব অনুযায়ী প্রতি মাসে ৪ শতাধিক প্রবাসীর লাশ যায় বাংলাদেশে।
চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার আব্দুল হামিদ গত ২২ সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আবুধাবিতে মারা যান। তার বন্ধু আবু তৈয়ব চৌধুরী বলেন, কমিউনিটিতে পরোপকারী হিসেবে পরিচিত আব্দুল হামিদ জুলাই আন্দোলনে প্রবাসে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ফলে কারাবরণসহ নানা আইনি জটিলতায় পড়েছিলেন। পরিবারের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ ছিল না দীর্ঘদিন। ফলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে দিনাতিপাত করছিলেন।
দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে তার লাশ দেশে পৌঁছালেও সে সৌভাগ্য হয়নি মোমেনার ক্ষেত্রে। দুবাইয়ের গৃহকর্মী মোমেনা হৃদরোগে মারা যান গত ১৭ জানুয়ারিতে। যশোরের মেয়ে মোমেনার পরিবার লাশ পরিবহন খরচের পয়সা জোগাড় করতে পারেনি, ফলে দুবাইয়ের সোনাপুরে সমাহিত করা হয় দুই সন্তানের জননী মোমেনার মৃতদেহ।
মৃত মোমেনার বোন পরিচয়ে ইয়াসমিন স্মৃতি জানান, দেশ থেকে সমিতি ও সুদের টাকা ধার করে সন্তানদের শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী করার আশায় দুবাইতে পাড়ি জমান। কিন্তু আশানুরূপ রোজগার না হওয়া ও পাওনাদারদের চাপে খুব চিন্তিত থাকতেন মোমেনা।
কল্যাণ বোর্ডের তথ্যানুসারে, ১৯৯৩ সাল থেকে গত ৩২ বছরে ৫৭ হাজার ২১৬ প্রবাসীর লাশ দেশে এসেছে। এই ৩২ বছরের তথ্যই বোর্ডের কাছে আছে। তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতি বছরই লাশের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে পাঠানো মৃতদেহের মৃত সনদ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কেবল হৃদরোগে মারা গেছে ৫৬৪ জন। এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৮ জন, কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় ১৯ জন, আত্মহত্যা করেছেন ৩২ জন ও অন্যান্য কারণে ৬১ জন মারা গেছেন। কল্যাণ বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, এর বাইরে অনেক লাশ বিদেশের মাটিতেই দাফন করা হয়। অনেক পরিবার লাশ দেশে আনতে চান না। যার ফলে পরিবারের অনুমতি সাপেক্ষে বিদেশেই লাশ দাফনের ব্যবস্থা করে সংশ্লিষ্ট দূতাবাস কর্তৃপক্ষ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রবাসী কর্মীদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ ‘হার্ট অ্যাটাক’। প্রবাসী বাংলাদেশি ও অভিবাসন খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ অভিবাসন ব্যয় প্রবাসীদের মানসিক চাপ বাড়ানোর অন্যতম কারণ। ঋণ নিয়ে বিদেশে গিয়ে টাকা পরিশোধ করার চাপের কারণে অতিরিক্ত কাজ করার প্রবণতা রয়েছে শ্রমিকদের মধ্যে। ১২-১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করার কারণে নিয়মিত ঘুমানোর সুযোগ পান না শ্রমিকরা। এসব কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।
আবুধাবির শিল্পনগরী মোছাফ্ফা সানাইয়ায় গত ১৭ মার্চ রাইসুল নামে এক নোয়াখালী প্রবাসী গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন। নিহতের চাচা মো. আবুল বাশার জানান, রাইসুল জর্দান প্রবাসী প্রেমিকা মারজানা আক্তার মায়াকে লাইভে রেখে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ১৯ বছরের এই তরুণ রাইসুলের সঙ্গে তার প্রেমিকার সম্পর্কের টানাপড়েন চলছিল।
আবুধাবি প্রবাসী ফ্যামিলি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. রোকসানা আক্তার কালবেলাকে জানান, সংযুক্ত আরব আমিরাত তথা বিদেশে অনেক বাংলাদেশি প্রবাসী হৃদরোগে অকালে মৃত্যুবরণ করছেন, এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পরিমিত খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এ ঝুঁকি অনেকটাই কমানো যায়। ধূমপান ও অতিরিক্ত চা-পানের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। প্রবাসে থেকেও নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়াই পরিবারের প্রতি সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
প্রবাসীদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পরিবার বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশি কমিউনিটির পরিচিত এ চিকিৎসক।
প্রবাসী কর্মীদের মৃত্যুর কারণ জানতে সরকারিভাবে কোনো গবেষণা করা হয়নি। তবে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, প্রবাসী কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা যান মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত বা ব্রেন স্ট্রোকের কারণে। আবার মৃতদের একটা বড় অংশই মধ্যবয়সি কিংবা তরুণ।
অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) ২০২৩ সালে ‘প্রাণঘাতী তাপ : উপসাগরীয় অঞ্চলে অভিবাসী কর্মীদের ওপর চরম তাপমাত্রা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকদের একটি বড় অংশ অবকাঠামো নির্মাণ খাতে কাজ করে। এই শ্রমিকদের দিনের বেলায় প্রচণ্ড তাপের মধ্যে কাজ করতে হয়। ফলে তাপজনিত নানা রোগে কিডনি, মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব দেশে তাপ আরও বাড়ছে। এতে মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসীদের মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে অতিরিক্ত তাপ।
মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, প্রবাসীদের লাশ সবচেয়ে বেশি আসে সৌদি আরব থেকে। এরপর সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, কুয়েত, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, ওমান থেকেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লাশ দেশে আসে। আরব আমিরাতের আবুধাবি দূতাবাসের কাউন্সিলার (শ্রম) মোহাম্মদ উল্লাহ খান প্রতিবেদককে জানান, আবুধাবি দূতাবাস থেকে ২০২০ সালে ২৬২টি, ২০২১ সালে ২২১টি, ২০২২ সালে ২০৮টি, ২০২৩ সালে ২২০টি এবং ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মোট ২৪৪টি মৃতদেহের ছাড়পত্র ইস্যু করা হয়েছে।
অথচ বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় আসে। দেশের অর্থনীতির দ্বিতীয় বৃহত্তম চালিকাশক্তি বৈদেশিক রেমিট্যান্স আয়ের এ খাতে সরকারের তেমন কোনো বিনিয়োগ নেই। কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি কমাতে ও প্রবাসী কর্মীদের স্বাস্থ্য বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে সরকার আরও ভূমিকা রাখবে এটাই প্রবাসীদের প্রত্যাশা।
মন্তব্য করুন