মানুষের জীবনে আল্লাহর দেওয়া অসংখ্য নিয়ামতের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান নিয়ামত হলো সন্তান। সন্তান শুধু এক টুকরো মাংসের অবয়ব নয়, এ এক হৃদয়ের অংশ, আত্মার প্রতিচ্ছবি। মা-বাবার জীবনে সন্তানের আগমন শুধু আনন্দের নয়, এটি এক মহান দায়িত্ব এবং এক বিশাল আমানতও।
মহান আল্লাহ তায়ালা স্বভাবতই মানুষের মনে সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা, স্নেহ ও দয়ার অনুভব সৃষ্টি করে দেন। এই অনুভব কোনো দুনিয়াবি লাভ-ক্ষতির হিসেবের উপর নির্ভর করে না; এটি আত্মিক এবং আধ্যাত্মিক।
কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার জীবনের শোভা। (সূরা কাহফ : ৪৬)
এই আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সন্তান দুনিয়ার এক সৌন্দর্য। কিন্তু এই সৌন্দর্য শুধু দেখার নয়, একে সংরক্ষণ করতে হয়, লালন-পালন করতে হয়, সুপথে পরিচালিত করতে হয়। হাদিস শরিফেও নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বহুবার সন্তানদের প্রতি দায়িত্বশীলতার কথা বলেছেন। তিনি তাদের প্রতি দয়া করতে বলেছেন। এ ছাড়া তাদের শিক্ষাদানের প্রতি গুরুত্বারোপ করে উত্তম চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তুলতে উৎসাহিত করেছেন।
বাংলাদেশের ধর্মভীরু সমাজে সন্তানকে ঘিরে আবেগ ও ভালোবাসা এক অসাধারণ মাত্রায় পৌঁছায়। মা-বাবারা সন্তানের জন্য যা করতে পারেন, তার কোনো পরিসীমা নেই। সন্তান যেন সব বিপদ-আপদ, রোগ-শোক, কুদৃষ্টি বা বদনজর থেকে রক্ষা পায়- এটাই অভিভাবকদের অন্তরের প্রার্থনা। এ কারণেই আমাদের সমাজে বহুদিন ধরেই কিছু প্রচলিত রীতিনীতি চলে আসছে, যেগুলোর উদ্দেশ্য মূলত সন্তানকে অদৃশ্য ক্ষতি থেকে রক্ষা করা।
তারই একটি প্রচলিত অভ্যাস হলো, শিশুর কপালে কালো টিপ দেওয়া। অনেকে বিশ্বাস করেন, এটি শিশুকে ‘বদনজর’ বা হিংসুক চোখের কুদৃষ্টি থেকে বাঁচায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইসলামের দৃষ্টিতে এই কাজটি কতটা বৈধ? এটি কি একটি সহিহ আমল, নাকি কুসংস্কার?
আরও পড়ুন : কারও শরীরে পা লাগলে হাত দিয়ে ছুঁয়ে সালাম করা কি জায়েজ?
বিশেষজ্ঞ আলেমদের দাবি, শিশুকে বদনজর থেকে রক্ষায় তার সৌন্দর্য কমানোর উপায় হিসেবে কপালে কালো টিপ দেওয়া নাজায়েজ নয়। একবার হজরত ওসমান (রা.) একটি সুদর্শন শিশুকে দেখে বললেন, তার চিবুকে একটি কালো দাগ দিয়ে দাও, যাতে তার ওপর অশুভ দৃষ্টি না পড়ে। (শরহুস সুন্নাহ লিলবাগাবী : ১২/১৬৬)
তবে কালো টিপের কোনো অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করা যাবে না। এটাকে লাভ-ক্ষতির চিহ্ন মনে করা যাবে না। কোনো রকম অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস থেকে কালো টিপ লাগালে তা নাজায়েজ ও গর্হিত পাপ হবে।
প্রখ্যাত ইসলামি স্কলার শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, রাক্ষুসে ভাব নিয়ে যদি কেউ তাকায়, তাহলে এই তাকানোর ফলে অনেক সময় সূক্ষ্ম ক্ষতি হয়। যেটা আমরা বুঝতে পারি না। টেরও পাই না। কিন্তু হাদিসের বর্ণনায় বোঝা যায়, মানুষ রাক্ষুসে বা হিংসাত্মক নজর দিয়ে তাকালে কোনো বস্তু বা ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু এসব থেকে বাঁচার জন্য কালো টিপ পরা যাবে না।
তিনি বলেন, শিশুর সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য কালো টিপ দিতে পারেন। কিন্তু কালো টিপ পরলে বদনজর থেকে রক্ষা পাবে- এই বিশ্বাস থেকে টিপ দেওয়া যাবে না। এটা কুসংস্কার।
শিশুকে বদনজর থেকে রক্ষার সুন্নত পদ্ধতি হলো, বিভিন্ন দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা। নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নাতি হাসান-হোসাইনের জন্য মহান আল্লাহর কাছে বদনজর থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে দোয়া করতেন।
শিশুর বদনজর প্রতিরোধে করণীয়
১. সকালে ও সন্ধ্যায় সাতবার করে নিয়মিত এই দোয়া পাঠ করুন: أعوذ بكلمات الله التامة من كل شيطان وهامة ومن كل عين لامة
উচ্চারণ : আউযু বিকালিমাতিল্লাহিত তাম্মাতি মিন কুল্লি শাইতানিওঁ ওয়া হাম্মাতিন, ওয়া মিন কুল্লি আইনিন লাম্মাতিন।
অর্থ : আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কালিমাত দ্বারা প্রত্যেক শয়তান, বিষাক্ত প্রাণী এবং প্রত্যেক কুদৃষ্টির অনিষ্ঠ হতে পানাহ চাচ্ছি। (বোখারি : ৩৩৭১)
২. সকালে ও সন্ধ্যায় সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পড়ে হাতে ফুঁ দিয়ে পুরো শরীরে বুলিয়ে দিন।
৩. সকাল ও সন্ধ্যায় তিনবার করে পাঠ করুন : بسم الله الذي لا يضر مع اسمه شيء في الأرض ولا في السماء وهو السميع العليم
উচ্চারণ : বিসমিল্লাহিল্লাযি লা ইয়াদুররু মাআসমিহি শাইয়ুন ফিল আরযি ওয়ালা ফিসসামা-ই ওয়াহুয়াস সামীউল আলীম।
অর্থ : আমি শুরু করছি সেই আল্লাহর নামে যার নামের সাথে পৃথিবীর ও আকাশের কোনো জিনিস ক্ষতিসাধন করতে পারে না এবং তিনিই সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞাতা। (আবু দাউদ ও তিরমিজি)
৪. কোনো কিছু দেখে ভালো লাগলে সুবাহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, মাশাআল্লাহ বলুন। তাহলে আপনার নজরের ক্ষতিকর প্রভাব ওই ব্যক্তি বা বস্তুর ওপর পড়বে না। কেউ ইতোমধ্যে বদনজরের শিকার হয়ে গেলে নিচের দোয়াটি পড়ে ফুঁ দিতে হবে। যেটি ফেরেশতা জিব্রাইল আলাইহিস সালাম নবীজিকে অসুস্থতার সময় পড়ে ফুঁ দিয়েছিলেন।
দোয়াটি হলো, بِاسْمِ اللهِ أَرْقِيكَ، مِنْ كُلِّ شَيْءٍ يُؤْذِيكَ، مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنِ حَاسِدٍ، اللهُ يَشْفِيكَ بِاسْمِ اللهِ أَرْقِيكَ উচ্চারণ : ‘বিসমিল্লাহি আরকিকা, মিন কুল্লি শাইয়িন ইয়ু’যিকা, ওয়া মিন কুল্লি আইনিন ও ওয়া হাসিদিন আল্লাহু ইয়াশফিকা, বিসমিল্লাহি আরকিকা।’ অর্থাৎ ‘আল্লাহর নামে আপনাকে ফুঁ দিচ্ছি; যেসব জিনিস আপনাকে কষ্ট দেয়, সেসব প্রাণের অনিষ্ট কিংবা হিংসুকের বদনজর থেকে আল্লাহ আপনাকে শিফা দিন; আল্লাহর নামে আপনাকে ফুঁ দিচ্ছি। (মুসলিম : ৫৫১২)
মন্তব্য করুন