বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বেশ ঘটা কর শবেবরাত পালন করার রেওয়াজ আছে বহুকাল ধরে। তবে শবেবরাতের সময় যেসব আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয় সেগুলো নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা বিতর্ক দেখা যায়। শবেবরাত পালন করা উচিত কি না, ইসলামে এর কোনো তাৎপর্য আছে কি না বা শবেবরাতের কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে কি না– এসব নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক চোখে পড়ে। প্রতিবেদন বিবিসি বাংলার।
ধর্মীয়ভাবে শবেবরাতের তাৎপর্য কতটুকু আছে সে বিষয়টি এ লেখায় আলোকপাত করা হয়নি। এর মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে শবেবরাতের আচার-অনুষ্ঠানগুলো দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে কীভাবে ও কেন প্রচলন হয়েছিল।
সূত্রপাত কখন?
ইসলামের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করা ব্যক্তিদের মতে মুসলিমদের মধ্যে শবেবরাত পালনের প্রথা শুরু হয় ইসলাম ধর্মের উৎপত্তির সময় থেকেই।
বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, হজরত মুহাম্মদ (সা.) শাবান মাসের ১৪ তারিখ যে সারা রাত নফল নামাজ পড়তেন ও কবরস্থান জিয়ারত করতেন, তা অনেক হাদিসেই বর্ণিত রয়েছে। পনেরো দিন পর রমজান মাস শুরুর প্রস্তুতি হিসেবে তিনি এই আচার পালন করতেন এবং তার অনুসারীদেরও পালন করতে বলতেন।
তার মতে, রাসুল (সা.)-এর সময়কাল এবং তার পরবর্তী সময়ে আরব থেকে ইসলাম প্রচারে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যারা সফর করেছেন, তাদের মাধ্যমেই বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার মানুষের মধ্যে শবেবরাত পালনের আনুষ্ঠানিকতার বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে।
আর এই আনুষ্ঠানিকতাকে উৎসব হিসেবে বিবেচনা করা হতো বলে ধীরে ধীরে এই দিনে ভালো খাবার তৈরি ও খাবার বিতরণের মাধ্যমে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার প্রথা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশে যেভাবে প্রচলন হলো
বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে শবেবরাত পালনের সবচেয়ে পুরোনো প্রমাণ পাওয়া যায় উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, প্রায় দেড়শো বছর আগে। সেসময় ঢাকার নবাবরা ঘটা করে শবেবরাত পালন করতেন বলে বলছিলেন ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, যিনি বাংলাদেশের উৎসবের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন ও বই লিখেছেন।
তিনি বলেন, সে সময়ে হিন্দুদের আধিপত্য থাকার কারণে সেটিকে মোকাবিলা জন্য ঢাকার নবাবরা শবেবরাতের জন্য অনেক বড় আয়োজন করত।
এতে ঢাকার নবাবদের মুসলমান পরিচয় এবং আধিপত্য- এ দুটো বিষয় একসঙ্গে তুলে ধরার প্রয়াস দেখা যেত।
অধ্যাপক মামুন বলেন, নবাবরা যেহেতু মুসলিম ছিলেন এবং ঢাকাকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতেন, সেজন্য উৎসবগুলোকে তারা গুরুত্ব দিতেন। এর মাধ্যমে নবাবদের আধিপত্য, মুসলমানদের আধিপত্য এবং ধর্ম পালন এই ৩টি বিষয় একসঙ্গে প্রকাশ হতো।
১৯শ শতকের শেষের দিকে ঢাকায় শবেবরাত পালন মুসলিম পরিচয় প্রকাশের বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। এমনটাই বলছেন অধ্যাপক মামুন। সেই ধারাবাহিকতায় শবেবরাত একটি বড় ধরনের উৎসবে পরিণত হয়েছে।
তবে মোহাম্মদ ইব্রাহিমের মতে আরও আগে থেকেই বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে শবেবরাত পালন হয়ে আসছে। আরব আর চীনা বণিকরা যখন সাগরপথে ব্যবসা করতে আসত, তখন চট্টগ্রাম অঞ্চলে তাদের জাহাজ ভিড়ত। সেসময় তাদের অনেকেই এখানে থেকে যেতেন। তাদের মাধ্যমে ইসলামিক রীতি-রেওয়াজের সঙ্গে সেখানকার মানুষের পরিচয় হয়েছিল বলেও জানান তিনি।
তার মতে ঢাকার নবাবরা জাঁকজমকের সঙ্গে শবেবরাত পালন করলেও তারও কয়েকশ বছর আগে থেকেই বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডের মানুষ এই রেওয়াজের সঙ্গে পরিচিত ছিল।
মন্তব্য করুন