শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ২ কার্তিক ১৪৩২
কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২৫, ০৮:৪১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

শহীদ মুগ্ধকে নিয়ে স্নিগ্ধর আবেগঘন লেখা

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

গত বছরের ১৮ জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গুলিতে শহীদ হন মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। আজ সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার এক বছর পূর্ণ হলো। ভাই হারানোর এই বেদনাবিধুর দিনে মুগ্ধর আপন ছোট ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ স্মরণ করেছেন সেই ভয়াল বিকেলের আগের দিনের কিছু স্মৃতিময় মুহূর্ত।

শুক্রবার (১৮ জুলাই) ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড আইডিতে ‘আজ একটা গল্প বলি’ শিরোনামে এক পোস্টে তিনি এসব কথা বলেন। পাঠকদের জন্য মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধর সেই স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো—

৯ অক্টোবর ১৯৯৮ সালে জন্মগ্রহণ করি আমরা দুই যমজ ভাই। জন্মের পর থেকেই আমরা নাকি গোলগাল প্রকৃতির ছিলাম। একইরকম দেখতে হওয়ায় অনেক সুবিধাও নিয়েছি—একজন আরেকজনের হয়ে। যখনই মাটিতে কিছু পড়ে থাকতে দেখতাম, সাথে সাথে দুজন দৌড় দিতাম—কে আগে সেটা বারান্দা দিয়ে বাইরে ফেলে দেবে! বারান্দা বন্ধ থাকলে বাথরুমে কমোডে ফেলে দিতাম আর খিলখিল করে হাসতাম। স্বর্ণের চেইন থেকে শুরু করে পায়ের জুতো—কোনো কিছুই আমাদের জন্য মাটিতে রাখা যেত না।’

জীবনে এরকম কত যে পরীক্ষা একে অপরের হয়ে দিয়েছি! কোনো শিক্ষক আজ পর্যন্ত ধরতেই পারেনি। এভাবেই আমাদের বড় হয়ে ওঠা—একসাথে। বুঝ হওয়ার পর থেকেই দু’জনের মধ্যে সবসময় প্রতিযোগিতা লেগেই থাকত। যদিও পড়ালেখায় ওর থেকে কখনো এগিয়ে থাকতে পারিনি, তবে ফ্রিল্যান্সিং থেকে শুরু করে অন্য সবকিছুতে আমাদের টক্কর হতো সমানে সমানে।

আর একটা জিনিস ছিল—ওর সাহস। সেই সাহসের উদাহরণ দিতে গেলে গল্প শেষ হবে না। ছোট থেকে বড় হওয়ার এই যাত্রায় আমরা প্রায় সারা বাংলাদেশ একসাথে ঘুরে বেরিয়েছি—কি করি নাই একসাথে!

১৭ জুলাই ২০২৪—মুগ্ধর মৃত্যুর একদিন আগেও আমরা প্রায় রাত ১টা পর্যন্ত একসাথে কাজ করে ঘুমাতে গিয়েছিলাম। সেই রাতেও প্রতিদিনের মতো মশারি টানানো নিয়ে আমাদের ঝগড়া হয়—এটা ছিলো নিত্যদিনের ঘটনা। আমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই মুগ্ধ নিজেই ডেকে আমাকে উঠিয়ে দিল। এমন আগে কখনো হয়নি—ও ঘুমের মধ্যে থেকে আমাকে ডেকেছে! আমাকে ঘুম থেকে তুলে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলছিলো—বিশেষ করে আম্মুকে নিয়ে। বলছিলো, ‘আম্মু সারাজীবন আমাদের জন্য কষ্ট করেছে, কিভাবে আম্মুকে নিজের টাকায় একটা ফ্ল্যাটে উঠাবে…’ ওর খুব শখ ছিলো—নিজের টাকায় একদিন আম্মুকে নতুন ফ্ল্যাটে তুলবে।

একপর্যায়ে কথা বলতে বলতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের ভিডিও বের করে দেখাচ্ছিলো—বলছিলো, ‘এখন খুলনায় থাকা উচিত ছিলো, জুনিয়রদের হেল্প করতে পারতাম।’ কথা বলতে বলতে প্রায় ৩টা বেজে গেলো, তবু ওর কথা শেষ হয় না। আমার তখন একদিন আগের এক্সিডেন্টে হাতের নখ উঠে গিয়েছিলো, ৫টা সেলাই—ভীষণ ব্যথা করছিলো। তাই একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘কী শুরু করলি? ঘুমাতে দে।’

এটাই ছিলো মুগ্ধর সাথে কাটানো আমার শেষ রাত।

সবচেয়ে বেশি ঝগড়া হতো জামাকাপড় নিয়ে। পরের দিন আন্দোলনে যাওয়ার সময় ও আমারই একটা জামা পরে বের হয়, আর যখন জানতে পারি ওর গায়ে গুলি লেগেছে—তখন আমিও ওর একটা শার্ট গায়ে দিয়ে বের হই। যখন মুগ্ধকে হাসপাতালে প্রথম দেখি—মনে হচ্ছিলো কি আরাম করে ঘুমাচ্ছে, এক শান্তির ঘুম! বোঝার কোনো উপায় ছিলো না যে ও আর নেই। মায়ের পেট থেকে যে একসাথে বেরিয়েছি—সে কিভাবে এভাবে একা চলে যায়?

সারা রাত ওর লাশের গাড়ির পাশে বসে ছিলাম—ঠিক প্রতিরাতের মতোই। পার্থক্য একটাই—গত রাতে ওর ভেতরে প্রাণ ছিলো, আজ আর নেই।

যতবারই সেদিন ওকে দেখেছি—মনে হচ্ছিলো ওর শরীর থেকে আলো বের হচ্ছে। জীবনে ওকে এতটা সুন্দর আর কখনো লাগেনি। এক পর্যায়ে মনে পড়লো—আম্মু-আব্বু তো তখনো জানে না মুগ্ধ আর নেই! তারা তখনো চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসছিলো। ভাবছিলাম, মা যখন মুগ্ধকে এই অবস্থায় দেখবে, তখন কী হবে?

অবশেষে সকালে তারা এলো। মুগ্ধর পাশে গিয়েই জানলো—মুগ্ধ আর নেই। সেইদিন শক্ত শাবল ভাইকে দেখলাম কিভাবে নিরীহ শিশুর মতো লাশের গাড়ি ধরে বিনা শব্দে কাঁদছিলো। কাঁদবেই বা না কেন? চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পুরো রাস্তায় আব্বু-আম্মু কিছু বুঝতে না পারে, সেই অভিনয় করতে গিয়ে ওর চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিলো—সেইদিনই একবারে বের হলো সব।

আম্মু বলতো—‘‘তোমাদের দু’জনকে একসাথে মানুষ করতে করতে আমার জীবনটা পানি হয়ে গেছে।’’ যাদের জমজ সন্তান আছে তারা জানে—দু’জনকে একসাথে বড় করা কতটা কঠিন। সেই আম্মুকে দেখলাম—কিভাবে নির্বাক হয়ে মুগ্ধর কপালে শেষ চুমু খেলো। চুমুর দৃশ্যটা দেখে মনে হচ্ছিলো—এক মা কপালে চুমু দেয়, আর আরেক মা, যাকে আমরা ‘‘দেশ’’ বলি—সে কপালে গুলি চালায়। আজ এতটুকুই থাক।

তারপর কীভাবে মুগ্ধকে কবর দেয়া হলো? কীভাবে ৫ই আগস্ট পর্যন্ত আমাদের ব্ল্যাঙ্ক চেক আর হুমকি-ধামকির মাধ্যমে কিনে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে—সেসব গল্প আরেকদিন বলবো।

যারা বাঁচে, তাদের দায় বেশি। কথা আছে—‘সত্য মরে না।’ মুগ্ধর গল্পও শেষ হবে না—কারণ ওর স্বপ্নগুলো এখন আমাদের শ্বাসে বাঁচে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দূরন্ত গতিতে ছুটছে নারায়ণগঞ্জ গ্ল্যাডিয়েটর্স

সিনিয়রদের পথে হাঁটতে ব্যর্থ প্রীতিরা

নিজেদের স্বার্থে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান

পাবনায় কালবেলার ৩য় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন 

চরফ্যাশনে কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত

নারায়ণগঞ্জে আবু জাফর আহমদের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু

গাইবান্ধায় কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত

ফেনীতে বর্ণাঢ্য আয়োজনে কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত

রাঙামাটিতে প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কালবেলার ৩য় বার্ষিকী উদযাপন

গোপালগঞ্জে কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত

১০

সব ব্যাঙ এক পাল্লায় ওঠানো যাবে না : মির্জা আব্বাস

১১

সাংবাদিক লাঞ্ছনায় প্রতিবাদ সমাবেশ

১২

জুলাই সনদে সই না করার ব্যাখ্যা দিলেন সারোয়ার তুষার

১৩

নোয়াখালীতে বর্ণিল আয়োজনে কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত

১৪

‘জুলাই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল কালবেলা’

১৫

নির্বাচন কীভাবে হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের প্রধান উপদেষ্টার আহ্বান

১৬

চাঁপাইনবাবগঞ্জে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ঘরে আগুন ধরিয়ে দিল দুর্বৃত্তরা

১৭

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সেমিনার অনুষ্ঠিত

১৮

মৌলভীবাজারে বর্ণাঢ্য আয়োজনে কালবেলার ৩য় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন

১৯

নারী ক্রিকেটে নতুন ইতিহাস গড়লেন ভারতীয় ব্যাটার

২০
X