

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) থেকে পদত্যাগ করেছেন দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. তাজনূভা জাবীন। রোববার (২৮ ডিসেম্বর) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক দীর্ঘ পোস্টে তিনি পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। দল ছাড়ার নেপথ্য কারণ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন তিনি।
ফেসবুক পোস্টে তাজনূভা জাবীন বলেন, এনসিপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর জোটের সিদ্ধান্তের চেয়েও বেশি উদ্বেগজনক হলো—যে প্রক্রিয়ায় এই জোট গঠিত হয়েছে। তার ভাষায়, এটিকে রাজনৈতিক কৌশল বা নির্বাচনি সমঝোতা বলা হলেও বাস্তবে এটি একটি পরিকল্পিত প্রক্রিয়া, যা ধাপে ধাপে সাজানো হয়েছে।
তিনি অভিযোগ করেন, সম্প্রতি সারা দেশ থেকে মনোনয়ন সংগ্রহ করে ১২৫ জনকে এনসিপির মনোনয়ন দেওয়ার পর হঠাৎ করে মাত্র ৩০টি আসনে সমঝোতার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যার ফলে বাকি প্রার্থীদের নির্বাচন করার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি সিদ্ধান্তটি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গোপন রাখা হয়েছে, যাতে কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও নির্বাচন করতে না পারে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন পত্রিকায় নানান খবর প্রকাশিত হচ্ছে। আমি মনোনয়ন হারানোর ভয়ে জোটের বিরোধিতা করছি। আমি কিছুদিন আগে লিখেওছিলাম আমার আসনে নেগোনিয়েশন হলে আমি নির্বাচন করব না, যত কঠিন প্রতিপক্ষ হোক আমি ফাইট দেব। দিলো না। তাদের গোষ্টীর ভাইরা তাদের পক্ষে দিস্তায় দিস্তায় লিখে ভরায় ফেলছে কেন আর কীভাবে এই জোট। কিন্তু কোন জেনারেল, ইসি মিটিং এর সিদ্ধান্ত এরকম ছিল না জোট হলে বাকি আসনে প্রার্থীকে বসে যেতে হবে। আবার বাকি আসনগুলোতে জামায়াতের হয়ে নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা করতে হবে। জামায়াতের সঙ্গে চরমোনাই পীরের ৭০টা আসনে সমঝোতা হচ্ছে। আর গণঅভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেওয়া দলের ৩০টা আসনে।
জামায়াতের সঙ্গে জোট প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, এনসিপি যে গণপরিষদ, দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র, মধ্যপন্থা, নারী ও বিভিন্ন জাতিসত্তার প্রতিনিধিত্বের রাজনীতির কথা বলে এসেছে, সেই রাজনীতিকে ধারণ করেই তিনি দলটিতে যুক্ত ছিলেন। তিনি নিজেকে দলের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য উল্লেখ করে বলেন, এই পরিস্থিতিতে দল ছাড়াই তার সামনে একমাত্র সম্মানজনক পথ।
তাজনূভা জাবীন বলেন, শীর্ষ নেতাদের মধ্যে পারস্পরিক ‘মাইনাসের রাজনীতি’ চলমান, যা একটি নতুন ও মধ্যপন্থার বাংলাদেশপন্থি রাজনীতি গড়ে তোলার পথে বড় বাধা। বিতর্ক তৈরি করে তাকে ‘বিপ্লব’ নামে উপস্থাপন করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, এনসিপি যদি স্বকীয়তা নিয়ে দাঁড়াতে পারত, তাহলে ভবিষ্যতে যে কোনো রাজনৈতিক জোটের সুযোগ থাকত। কিন্তু প্রথম নির্বাচনেই পরিকল্পিতভাবে সব বিকল্প পথ বন্ধ করে জামায়াতের সঙ্গে জোটে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
তিনি বলেন, জবাবদিহির কথা বলা হলেও বাস্তবে ভিন্নমত পোষণকারীদের ‘মাইনাস’ করা হচ্ছে। বর্তমান এনসিপি আর সেই এনসিপি নেই।
জাবীন বলেন, আমি আগে রাজনীতি করি নাই, ঠিক। কিন্তু এরা কে আগে জাতীয় রাজনীতি করেছে? আমি নিজে বের হয়ে দলের বদনাম করছি, বলতে পারেন। বিষয়টা আমারও ভালো লাগছে না। কিন্তু সেটার থেকে আমার কাছে বেশি জরুরি মানুষ যে এনসিপির দিকে তাকিয়ে আছে, এনসিপিকে এটা সেটা ভেবে, এনসিপি ওটা না। এনসিপিকে আমরা যারা ওটা করতে চেয়েছি তাদেরকে ট্যাগিং করা হয়েছে নানাভাবে। আমরা যারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, তারা একে একে ছাড়ছি। যাতে এই শক্তি গঠনে ব্যয় হয়, এই চেষ্টাটা প্রোডাকটিভ ভাবে করতে পারি। এখন কলুর বলদ খাটছি।
তিনি বলেন, নিজেরও ভালো লাগছে না, এভাবে ছেড়ে যেতে। কিন্ত যারা এই দেশ, এই সংসদই চায় নাই তাদের সমঝোতায় একদম শুরুতেই এমপি হতে চাওয়া, বা যারা এদের কল্যাণে এমপি হওয়ার জন্য হাভাইত্তার মতো করছে তাদের নেতৃত্ব মানা আমার পক্ষে ঠিক গণঅভ্যুত্থানের পরের বছর অসম্ভব। এই জিনিস হজম করে মরতেও পারব না আমি। আমার নেতা হবে মাজাওয়ালা, জুলাই রাজনীতির ধারক। কিন্তু পুরো জুলাইকে নিয়ে রাজনৈতিক কৌশলের নাম করে তুলে দিচ্ছে জামায়াতের হাতে। আবার নাকি বাউন্স ব্যাক করবে, হাস্যকর।
বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের জোটের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লেখেন, বিএনপি, এই জামায়াতের সঙ্গে জোট করে ১৭ বছর ক্ষমতা থেকে দূরে ছিল। আর বিএনপির অধীনে জামায়াতের সঙ্গে জোট হয়েছিল। জামায়াতের অধীনে না। যেখানে এনসিপিকে বলাই হয় জামায়াতের আরেকটা দোকান, তাহলে কেন এনসিপি আগে নিজের স্বকীয়তা, নিজের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা না করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জামায়াতকে বেছে নিতে মরিয়া হয়ে যাচ্ছে? তিনজন মন্ত্রী ছিল না ক্ষমতায়? পারে নাই তো।
জাবীন বলেন, ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা যায় কৌশল করে, কিন্তু সংগঠন দাঁড় করাতে যোগ্যতা লাগে। আপনারা মিলায় নেবেন, যারা এনসিপি ছাড়ছি তারাই এনসিপির বলা নয়া বন্দোবস্তের রাজনীতি করেছি। কিন্তু ছাড়তে হচ্ছে আমাদের। পার্টিতে থাকা অবস্থায় কোনো শোকজ না পেয়ে, সম্পূর্ণ পার্টির ইন্টিগ্রিটি মেনে যখন ছেড়ে আসতে চাই, তখন “অরাজনৈতিক” তকমা পরে। আপনারা এটাও মিলায় দেখেন কত কয়েক মাসে কোন কোন নেতা কত অসংখ্যবার পার্টির ইন্টিগ্রিটি ভেঙে বক্তব্য দিয়েছেন, বিভিন্ন কাজ করেছেন। কিন্তু তারা মিলিয়ন ফলোয়ারওয়ালা গণঅভ্যুত্থানের নেতা, তাই তারা নির্বাচনি জোটের নামে বাকিদের নির্বাচন করার অধিকার কেড়ে নিয়ে এমপি হতে পারেন আর আমরা পদত্যাগও করতে পারব না? সেটাকে অপরাধ হিসেবে দেখা হবে।
এই নেত্রী বলেন, নির্বাচন কেন্দ্র করে প্রচুর পজিটিভ পিআর হবে এসব নেতাদের ঘিরে। কিন্তু আমি নিশ্চিত এরা নয়া বন্দোবস্ত না, এরা মধ্যপন্থার রাজনীতি না। আপনারা বলতে পারেন, এসব আগে থেকেই জানতেন। কিন্তু এই দলে অনেকে আছে/ছিল যারা আদৌতেই এনসিপির রাজনীতি করেছে। তাদেরকে এম্পাওআরড করা হয় নাই ইচ্ছাকৃতভাবে। আপনারা তাদেরই চেনেন যাদের এনসিপি চেনাতে চেয়েছে। জুলাই এর যে স্পিরিট সেটা এনসিপিতে চর্চা করা হয় না, ব্যবহার করা হয়। যারা চর্চা করত, তাদের “নীতি কথা বলা যায় অনেক, বিপ্লব দিয়ে রাজনীতি হয় না, আবেগ দিয়ে রাজনীতি হয় না” ইত্যাদি বলে থামানো হয়, যাতে তারা নিজেদের ভন্ডামি চালিয়ে যেতে পারে।
জাবীন বলেন, আরেকটা বিষয় দেখলাম, বিএনপি গণভোটে না ভোটকে জেতায় আনবে তাই সেটা ঠেকানোর জন্যই এই কৌশল। আমার প্রশ্ন, হ্যাঁ ভোট জেতানোর জন্য এনসিপিকে ৩০টা আসনে সীমিত হতে হল? যে লিস্ট ঘুরছে তাদের ৬০-৭০ শতাংশ এর রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড দেখেন। আমার চেয়ে ভালো জানবেন। এরপরও এনসিপির জোর করে চেপে বসে থাকা নেতাদের মধ্যে যদি এনসিপির রাজনীতি নিয়ে পরিকল্পনা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দেখতাম, জবাবদিহি পেতাম, তাহলে আমি আরও চেষ্টা করতাম টিকে থাকার। এখন সময় নষ্ট না করি আর।
জামায়াত-এনসিপির জোট নিয়ে তিনি বলেন, ভেবেছিলাম, জোটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার পর আমি পদত্যাগ দেবো। শেষ আশাই ছিলাম। কিন্তু গতকাল সবাই নিশ্চিত করেছে এই জোটে সিল পরেছে। আর আবারও বলি, আমার পদত্যাগের কারণ যতটা না জোট তার চেয়ে বেশি যে প্রক্রিয়ায় জোট হয়েছে। অবিশ্বাস, অনাস্থা মূল কারণ। দল অনেক বড় হয়ে স্টাবলিশ করতে পারলে অনেক কিছু বিবেচনা করে ছাড় দেওয়া যেত। কিন্তু গঠনের শুরুটাই নাকি আগে সংসদে যেতে হবে, তারপর ওই যে কজন এমপি বের হবে তাদেরকে কেন্দ্র করে নাকি সংগঠন বড় হবে।
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না জানিয়ে তাজনূভা জাবীন বলেন, যাই হোক, আমি আজকে পদত্যাগ করেছি এনসিপি থেকে। অত্যন্ত ভাঙা মন নিয়ে জানাচ্ছি আমি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারছি না। সবচেয়ে কষ্ট লাগছে আজকেই আম্মু চট্টগ্রাম থেকে আসছে আমার নির্বাচন করা উপলক্ষ্যে, আর আজকেই আমি এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম। আমি জানি অনেকে ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন আমার এই সিদ্ধান্তে। কিন্তু এটাই আমার জন্য সঠিক। এখানে ন্যূনতম আশা থাকলে, আমি আমার আত্মসম্মানবোধকেও বোধ হয় ডাউট অফ বেনিফিট দিতাম।
তিনি বলেন, আমি আপনাদের পাঠানো ডোনেশন ফেরত দেব এক এক করে। আমাকে একটু সময় দেবেন। সেটার জন্য বিস্তারিত লিখে আপডেট দেব কীভাবে ধীরে ধীরে ফেরত দেব। প্রত্যেকটা পয়সা ফেরত দেব। আপনাদের সমর্থন, আপনাদের ভালোবাসার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।
শেষে তিনি বলেন, শেষ কথা বলি, আমি আগে কখনো রাজনীতি করি নাই। জুলাই এ আমার রাজপথে নামা, পরিবর্তনের লক্ষ্যে নতুন কিছুর জন্য। আমি মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেই চেষ্টা করতে থাকব। আমার আওয়াজ, দেশের গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য কাজ আরো জোরালোভাবে জারি থাকবে। মধ্যপন্থার বাংলাদেশপন্থি নয়া বন্দোবস্তের রাজনীতির জায়গাটা খালিই পড়ে থাকল। আমি ওই জায়গা পূরণ করার চেষ্টায় থাকব। সময় বলে দিবে বাকিটা।
মন্তব্য করুন