২০২২ সালের এপ্রিলে পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলার পরপরই পাক-ভারত সীমান্তবর্তী অঞ্চল দীর্ঘদিন অস্থিতিশীল ছিল। এ সময় জঙ্গিবাদের কারণে দীর্ঘদিন ওই অঞ্চলে ভারতীয় বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। তবে বর্তমানে এ দুই দেশকে ভুল উপমা হিসেবে অ্যাখ্যা দেওয়া শুরু হয়েছে। অনেকেই বলছেন, ভারত ইসরায়েল হয়ে যাচ্ছে, আর পাকিস্তানকে নতুন ফিলিস্তিন হিসেবে দেখানো হচ্ছে।
অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে কিছু শিক্ষাবিদও এ তুলনা করছেন। এতে করে মূলত মধ্যপ্রাচ্যের সংকটকে দক্ষিণ এশিয়ার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু এ তুলনা আসলে ভুল। ইতিহাস, বাস্তবতা ও নৈতিক দিক থেকে এটা সম্পূর্ণভাবে বিভ্রান্তিকর।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত মূলত সামরিকভাবে প্রভাবশালী ও দখলদার ইসরায়েলের অধীনে বসবাসকারী গাজার জনগণের সঙ্গে সংঘাত। এতে অসম ক্ষমতা, সার্বভৌমত্ব অস্বীকার ও চলমান আঞ্চলিক অধিগ্রহণ রয়েছে। অন্যদিকে, ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই স্বাধীন। তারা ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত ভাগের মাধ্যমে তৈরি হয়। দুদেশেরই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানা রয়েছে এবং দুটি দেশই জাতিসংঘের সদস্য।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব হচ্ছে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র আর একটি রাষ্ট্রহীন জনগণের মধ্যে লড়াই। এখানে শক্তির ভারসাম্য নেই। ফিলিস্তিনিরা দখলদারির নিচে বাস করছে, স্বাধীনতা পাচ্ছে না।
যদিও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক দ্বন্দ্ব রয়েছে কাশ্মীর নিয়ে। তবে তা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা অস্বীকারের জন্যে নয়। এ দ্বন্দ্ব কাশ্মীরের অমীমাংসিত আঞ্চলিক দাবি নিয়ে। পাকিস্তান বারবার কাশ্মীরকে ফিলিস্তিনের সঙ্গে তুলনা করে আসল ইতিহাস আড়াল করছে, যেখানে পাকিস্তান ভারতের অভ্যন্তরে বহুবার সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়েছে- পাঞ্জাব থেকে কাশ্মীর, এমনকি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও।
পাকিস্তানের কার্যকলাপকে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের সঙ্গে তুলনা করাও ভুল। কারণ ফিলিস্তিনিরা দখলদারত্বের বিরুদ্ধে লড়ছে। অন্যদিকে পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন ও আশ্রয় দিয়ে এসেছে। আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থাও এ দায় স্বীকার করেছে।
তাই পাকিস্তানকে কোনো কিছুর শিকার না বলে বরং আক্রমণকারীই বলা উচিত।
সংখ্যালঘু, গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো
এ তুলনার আরও একটি বিপজ্জনক দিক হলো উভয় অঞ্চলে অভ্যন্তরীণ সংখ্যালঘুদের অবস্থান নিয়ে ভুল উপস্থাপনা। এটা সত্য যে, সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, মেরুকৃত আলোচনা এবং মুসলিমদের প্রান্তিকীকরণের নীতির জন্য ভারত সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছে। কিন্তু এটা বললে ভুল হবে যে, ভারতের মুসলিমদের অবস্থা ফিলিস্তিনিদের মতো।
ভারতে মুসলিমরা এখনো নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভোটার, সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত নাগরিক- যাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকার রয়েছে। ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বা সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের মতো মুসলিম নেতারা ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এখনো আসাদউদ্দিন ওয়াইসি ও সালমান খুরশিদের মতো মুসলিম রাজনীতিকরা রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে বৈদেশিক সফরেও অংশ নিচ্ছেন। তাদের এ উপস্থিতিতে প্রমাণ হয়, বিরোধিতা সত্ত্বেও তারা সম্মান পাচ্ছেন।
অন্যদিকে, পাকিস্তানে আহমদিয়াদের মুসলিম হিসেবে স্বীকৃতি নেই। শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা প্রায়ই হামলার শিকার হন। এবং ব্লাসফেমি আইন সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এগুলো শুধু সামাজিক পক্ষপাত নয় বরং আইনগত ও রাজনৈতিকভাবে প্রোথিত পদ্ধতিগত বর্জন।
ফিলিস্তিনে আবার পরিস্থিতি অন্যরকম। ওখানে জনগণের কোনো রাষ্ট্র নেই। সাধারণ মানুষ দখলদার সেনার অধীনে বাস করছে, তাদের চলাচলের স্বাধীনতা নেই, ন্যায়বিচারের স্বাধীনতা নেই। এ প্রেক্ষাপটগুলোকে এক করলে প্রতিটি সমস্যার নিজস্ব সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
সন্ত্রাসবাদ, দখলদারত্ব ও নীতি
ভারতের নিরাপত্তা নীতিতে বরাবরই জোর দিয়ে বলা হয়েছে, তাদের সংঘাত পাকিস্তানের জনগণের সঙ্গে নয় বরং সামরিক-গোয়েন্দা অস্ত্র এবং রাষ্ট্রীয় কৌশল হিসেবে সন্ত্রাসবাদের ব্যবহারের বিরুদ্ধে। কাশ্মীরের জঙ্গিবাদ, পাঞ্জাবের খালিস্তানি আন্দোলন, এমনকি উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অস্ত্র প্রবেশ থেকে শুরু করে ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে উত্তর-পূর্বে অস্ত্র প্রবাহ পর্যন্ত, ভারতের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ– সবই বাইরের সহায়তায় হয়েছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েল প্রায়ই ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র প্রতিরোধের বিরুদ্ধে অসম শক্তি প্রয়োগ করেছে। বাড়িঘর ভেঙে ফেলা, শরণার্থী শিবিরে বোমাবর্ষণ ও সম্মিলিত শাস্তি নীতি প্রয়োগ করা। এতে বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তাই বলে ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানকে ইসরায়েলের শক্তি প্রয়োগের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করা ভুল হবে। কারণ দুই দেশের কৌশল, উদ্দেশ্য ও পরিস্থিতি আলাদা।
ভারত দীর্ঘদিন ধরেই ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে এসেছে। এমনকি মোদি সরকারের সময়েও, যখন ইসরায়েলের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বেড়েছে, তখন ভারত জাতিসংঘে বারবার দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের প্রতি তার সমর্থন জানান দিয়েছে। জাতিসংঘের ফোরামেও দখলদারত্বের বিরুদ্ধে কথা বলেছে ভারত। তাই ভারত কখনই ইসরায়েলের মতো নীতি গ্রহণ করেনি। বরং, ভারত চেষ্টা করেছে ভারসাম্য বজায় রাখতে।
এই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে বিশ্লেষণ করলে এ দুই দেশের তুলনা শুধু ভুল নয়, কূটনৈতিকভাবেও ক্ষতিকর। এতে ভারতের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে, বিশেষ করে যখন ভারত নিজেকে গ্লোবাল সাউথের পক্ষে এক নেতৃস্থানীয় শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পাকিস্তান যেভাবে সন্ত্রাসবাদ এবং ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে পররাষ্ট্রনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, সেটিকে ফিলিস্তিনি সংগ্রামের সঙ্গে তুলনা করা মানে হলো ফিলিস্তিনকে অপমান করা।
ভুল তুলনা বন্ধ করুন
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন এবং ভারত-পাকিস্তান উভয় দ্বন্দ্বই বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব বহন করে। তবে এর অর্থ এই নয়, দুটি বিষয়কে এক করে ফেলতে হবে। ফিলিস্তিন সংকট মানবাধিকারের প্রশ্ন – ভূমি, বাস্তুচ্যুত ও রাষ্ট্রহীনতার। অন্যদিকে, ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব হলো দুটি স্বাধীন দেশের মধ্যে বিরোধ, যেখানে একটি দেশ বারবার সন্ত্রাসকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছে।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি থাকা ভালো। তবে সেই সহানুভূতিকে ব্যবহার করে ভুল তুলনা তৈরি করলে, দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রীয় দায় থেকে চোখ ফেরানো হয়। ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপগুলোকে দখলদার শক্তির সঙ্গে তুলনা করাও ভুল। ভারতের বৈধ সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযানগুলিকে বসতি স্থাপনকারী-ঔপনিবেশিক সহিংসতার সাথে জুড়ে দেওয়া উচিত নয়।
বর্তমানে এ বিষয়ে একটি পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি থাকা দরকার। ভারত ইসরায়েল না, পাকিস্তানও ফিলিস্তিন না। এ ভুল তুলনা ইতিহাস, কূটনীতি ও শান্তির প্রয়োজনে অবিচার করে।
আশরাফ নেহাল ভারতীয় লেখক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
এনডিটিভি থেকে
মন্তব্য করুন