দেশের ইস্পাত শিল্পের কাঁচামালের অন্যতম জোগানদাতা ‘জাহাজভাঙা শিল্প’। বর্তমানে বিলেট থেকে রড উৎপাদন হলেও দেশের ইস্পাত শিল্পের প্রায় ৫০ শতাংশ কাঁচামালের জোগান দেয় এই শিপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রি। আগামী বছরের ২৬ জুনের মধ্যে জাহাজ কাটার সব ইয়ার্ডকে গ্রিন ইয়ার্ডে রূপান্তরের বাধ্যবাধকতায় হংকং কনভেনশন নামে একই আইন বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে, যা বাস্তবায়ন শুরু হলে কেবল গ্রিন শিপইয়ার্ডগুলোই ভাঙার জন্য আনতে পারবে জাহাজ। বিষয়টি জাহাজভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের জন্য আশার খবর হলেও মালিকদের জন্য ‘দুঃসংবাদ’। কারণ বর্তমানে নানা সংকটে ইস্পাত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎপাদন কমে অর্ধেকে নেমেছে। অন্যদিকে গ্রিন শিপইয়ার্ড রূপান্তর ব্যয়বহুল। এজন্য একেকটি ইয়ার্ডের খরচ হয় ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকা। এই বাড়তি খরচের জন্য সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিদেশি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। এরই মধ্যে জাহাজভাঙা শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে উদ্যোগী হতে দেখা গেছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। ফলে সব মিলিয়ে আগামী বছরের জুন মাসের মধ্যেই নতুন করে আরও ২০টি ইয়ার্ড ‘গ্রিন তকমা’ পাওয়ার সম্ভাবনার তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, দেশে এখন পর্যন্ত গ্রিন হয়েছে মাত্র পাঁচটি শিপইয়ার্ড। প্রক্রিয়াধীন রয়েছে আরও ২০টি। এর মধ্যে নির্ধারিত সময়ে শর্ত পূরণ করতে পারে ১৩ থেকে ১৪টি। ফলে চালু থাকা ৪১টি ইয়ার্ডের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই হবে শর্ত পূরণে ব্যর্থ। আর এর অন্যতম কারণ মূলধন। এ কাজে ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকার প্রয়োজন, যা সরকারি সহায়তা ছাড়া ব্যবস্থা করতে পারছেন না অনেকেই।
তথ্য বলছে, চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূলে থাকা শিপইয়ার্ডগুলো থেকে বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পায় সরকার। এ ছাড়া দেশের ইস্পাত শিল্পের প্রায় ৫০ শতাংশ কাঁচামালের জোগান হয় এখান থেকে। এতে প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান ২০ হাজার। কিন্তু আগামী বছর বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশের বড় এ শিল্প। গ্রিন শিপইয়ার্ডে পরিণত না হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো বিপাকে পড়লে যার প্রভাব পড়তে পারে সমগ্র শিল্পে। এ অবস্থায় জাহাজভাঙা শিল্পে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দিকে তাকিয়ে উদ্যোক্তারা।
জাহাজভাঙা শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) সহসভাপতি ও পিএইচপি শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম রিংকু কালবেলাকে বলেন, হংকং কনভেনশনের আদলে উন্নীত ইয়ার্ডগুলোই শুধু জাহাজ আনতে পারবে। অন্যরা পারবে না। ফলে এটির একটি বড় প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠি দিয়েছে যেন আমাদের ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময় দেন। কারণ করোনাকাল থেকেই এই শিল্পে আর্থিকভাবে একটি মন্দাভাব চলছে, যা আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর খুব প্রভাব ফেলেছে। ফলে আমরা মন্ত্রণালয়ে অনুরোধ করেছি। কিন্তু এটা যেহেতু একটি ইন্টারনেশনাল কনভেনশন, ফলে তা পরিবর্তন করা এত সহজও না। তাই আমাদের যা করতে হবে, ইন্টারনেশনাল কনভেনশন যখন তালিকাভুক্ত হবে তখন আমাদের এই বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করতে হবে। যেন আমরা সময় বৃদ্ধির জন্য অনুরোধ করতে পারি।
বিএসবিআরএর প্রেসিডেন্ট মো. আবু তাহের কালবেলাকে বলেন, ঘোষণা অনুযায়ী আর মাত্র সাত মাস পর শেষ হতে যাচ্ছে গ্রিন শিপইয়ার্ডে রূপান্তরের সময়সীমা। আমাদের চারটা ইয়ার্ডের সমান পার্শ্ববর্তী ভারতের একটি ইয়ার্ড। আশা করি, ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে আমাদের আরও ২০টি ইয়ার্ড ‘গ্রিন তকমা’ পাবে। আমরা বর্তমানে পাঁচটি ইয়ার্ডের সার্টিফিকেট পেয়েছি, বাকি ইয়ার্ডগুলোর কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যেই নতুন করে চার-পাঁচটি ইয়ার্ড গ্রিন সার্টিফিকেট পেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ইস্পাত শিল্পে মন্দা চলছে। ফলে জাহাজভাঙা শিল্পেও তার প্রভাব পড়েছে। আশা করি, দেশের পরিস্থিতি ঠিক হতে হতে আমরা এসব সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব।
এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের একটি ক্লাবে বিএসবিআরএর ৪১তম বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বক্তারা বলেন, দেশে বছরে চার মাস বৃষ্টিপাত থাকে। এ সময় ইয়ার্ডগুলো কর্দমাক্ত হয়ে পড়ে। ফলে পুরো ইয়ার্ড কংক্রিট ঢালাই করতে হয়। এ ছাড়া জাহাজ একটু দূরে থাকলে সেখানে বার্থিং সিস্টেম এবং ভারি ক্রেনসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতির প্রয়োজন পড়ে। একেকটি শিপইয়ার্ডকে গ্রিন শিপইয়ার্ডে পরিণত করতে ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকার প্রয়োজন। এ অবস্থায় স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ এবং বিদেশিদের এ খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানান তারা।
সভার সভাপতিত্ব করেন বিএসবিআরএর প্রেসিডেন্ট মো. আবু তাহের। এ সময় বিএসবিআরএর সিনিয়র ও উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য শওকত আলী চৌধুরী, উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য মো. শাহজাহান, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী চৌধুরী, ভাইস প্রেসিডেন্ট জহিরুল ইসলাম রিংকু, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. করিম উদ্দিন এবং নির্বাহী সদস্যরা উপস্থিতি ছিলেন।
সভায় শিপ রিসাইক্লিং কনসালটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, দেশের বাইরের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা অন্য কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে জাহাজ শিল্পে বিনিয়োগ করলে এটি আমাদের জন্য সুবিধা হবে।
এদিকে গত ১৯ নভেম্বর যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) কাউন্সিলের ১৩৩তম অধিবেশনে যোগ দেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি সেখানে বলেন, জাহাজভাঙা শিল্পকে নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব করতে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ করতে কাজ করছে সরকার। এ সময় উপদেষ্টা উন্নত বিশ্বের ধনী রাষ্ট্রগুলোকে বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বিনিয়োগের আহ্বান জানান।