লে. কর্নেল (অব.) তপন মিত্র চৌধুরী
প্রকাশ : ২১ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২১ জুন ২০২৩, ০৯:৩২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কল্যাণময় ও প্রশান্ত জীবনের জন্য যোগ

কল্যাণময় ও প্রশান্ত জীবনের জন্য যোগ

যিশুখ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ২৭০০ বছর আগে সিন্ধু সরস্বতীর কূলে তখনকার জ্ঞানী ব্যক্তিরা কল্যাণময় প্রশান্ত জীবনযাপনের এক পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। সেই আদিকাল থেকে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে এর রূপরেখা টেনেছেন এবং একপর্যায়ে মহর্ষি পতঞ্জলির হাতে এ ধারণাটি পূর্ণতা পায়। এ পদ্ধতির নাম যোগ।

যোগ কী? এটা জানার আগে পরিষ্কার হওয়া উচিত—‘যোগ’ কী নয়। যোগ সম্পর্কে যে প্রধান ভুল ধারণা প্রচলিত সেটা হচ্ছে, যোগ কোনো এক বিশেষ ধর্মের বা বিশ্বাসীদের। এটা নিতান্তই অজ্ঞতাপ্রসূত। যোগ কোনো ধর্ম নয়। যোগ জীবনে চলার এক পদ্ধতি, যার মাধ্যমে শারীরিক সুস্থতা ও মন নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অর্জন করা যায়। অনেকে আবার মনে করেন, বিভিন্ন আসনই যোগ। এটাও সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা নয়। যোগের অনেক পর্যায়ের মধ্যে একটি হলো আসন। এটা শরীরবৃত্তিয় কর্মকাণ্ড বা অনুশীলন। যোগের আটটি স্তর বা পর্যায় আছে। যেমন—সম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি। সব নিয়ম পালন না করে শুধু আসন প্রাণায়াম করলে সীমিত ফল লাভ হবে। যোগের সম্পূর্ণ মাধুর্য অনুভব করা যাবে না।

এসব নিয়ম বিশেষ কিছু নয়। একজন সাধারণ মানুষের যে নৈতিকতা, সেগুলোর সমন্বয়। যেমন—সম অর্থ সর্বজনীন নৈতিকতা, অহিংসা, সত্যবাদিতা, চুরি না করা ও লোভ না করা। নিয়ম মানে আধ্যাত্মিকতা ও সশৃঙ্খলা। এর মধ্যে আছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, তৃপ্তি, নীতি নিষ্ঠা, অধ্যয়নের মাধ্যমে জ্ঞান আহরণ ও সর্বোপরি সৃষ্টিকর্তার প্রতি অবিচল বিশ্বাস। একজন মানুষ যোগের এই প্রথম দুটি স্তর যদি পালন করেন, তিনি আদর্শবান ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। আসন বলতে আমরা বিভিন্ন যোগাসনকে বুঝি। যেমন—শবাসন, কুর্মাসন, ভুজঙ্গাসন, পদ্মাসন, পদহস্তাসন, শীর্ষাসন ইত্যাদি। যোগ অনুশীলনের সঙ্গে অন্যান্য শারীরিক অনুশীলনের পার্থক্য হলো—যোগাসনে প্রতিটি আসনে কখন শ্বাস গ্রহণ করবেন, কতক্ষণ ধরে রাখবেন এবং কখন ত্যাগ করবেন; এ বিষয়ে যথেষ্ট সজাগ থাকা। এরপর প্রাণায়াম। বিভিন্ন পদ্ধতিতে নিঃশ্বাস গ্রহণ (পুরক), ধারণ (কুম্ভক) ও ত্যাগ করাকে (রেচক) প্রাণায়াম বলে। এখান থেকে মন নিয়ন্ত্রণের অনুশীলন শুরু। নাক দিয়ে বাতাস ঢুকে কীভাবে গলা দিয়ে প্রবেশ করে ফুসফুসে যাচ্ছে আর কীভাবে আবার সেই বাতাস বের হয়ে আসছে সেটা তীক্ষ্ণভাবে অনুভব করতে হবে। না হলে প্রতিদিন আমরা হাজার হাজারবার অবচেতনভাবে নিঃশ্বাস গ্রহণ বা ছাড়ার যে কাজ করছি, তার সঙ্গে প্রাণায়ামের কোনো পার্থক্য থাকবে না। এরপর দরকার মনের নিয়ন্ত্রণ। প্রত্যাহার দিয়ে তা শুরু। সহজ কথায়, একান্ত প্রয়োজনের বাইরের দ্রব্য বর্জন। যার দরকার তার অনেক কিছুই লাগবে। সবার তো আর সবকিছু লাগার কথা নয়। অমুকের আছে আমারও থাকতে হবে, এ নীতি ছাড়তে হবে। তাহলে জীবনে দীর্ঘশ্বাসের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। বস্তু দিয়ে সুখী হওয়া যায় না। সুখ ও শান্তি মেলে সন্তুষ্টিতে। পরের পর্যায় ধ্যান। কীসের ওপর ধ্যান করব? সে জন্য আগে থেকে ধারণা থাকা দরকার। কোনো কিছুর রূপ, শব্দ বা গুণ নিরবচ্ছিন্নভাবে একাগ্র মনে চিন্তা করাকে ধ্যান বলে। ধ্যানের বিষয়বস্তু কী হবে সেটা ব্যক্তির ওপরই নির্ভর করে। কেউ সাকার ধ্যান করতে পারেন, কেউবা নিরাকার। কেউবা শুধু সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করতে পারেন। আবার অনেকে বিশাল পর্বত বা বিস্তৃত সবুজ ভূমি বা যে কোনো কিছু যা ভালো লাগে, যেখানে মন শান্তি পায়, সেটা নিয়েই ধ্যান করা যায়। সবশেষে সমাধি। যখন ধ্যানী ও ধ্যেয় একবিন্দুতে লয় হয়ে যায়, সেটাকে বলে সমাধি। এ পর্যায়ে ধ্যানীর বাহ্যিক সত্তা লোপ পায়। সাধারণ মানুষ এ অবস্থায় কয়েক সেকেন্ড থাকতে পারে। যারা অভিজ্ঞ ও নিবেদিত, যাদের পৃথিবীর কাছে কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই, তারা দীর্ঘ সময় থাকতে পারেন।

যোগ করে লাভ কী? যোগের উপকারিতা অনেক। শুধু প্রস্তুতি পর্বের কথাগুলো মনে রাখলেও একজন মানুষ নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটাতে পারে। আমি যদি বস্তুতান্ত্রিক প্রতিযোগিতায় না নামি তাহলে আমার জীবনটা ঝামেলাবিহীন হবে। যোগ অনুশীলন সবচেয়ে কম খরচে ও কম সময়ে নিজ বাড়িতে, ছাদে বা আঙ্গিনায় করা যায়। শরীরচর্চা কেন্দ্রে যেতে-আসতে সময় ব্যয় হয়। মাসে মাসে গোল্ড বা সিলভার কার্ডের সাবস্ক্রিপশন ফি দিতে হয়। নির্দিষ্ট সময় স্লটে হাজিরা দিতে হয়। এখানে সেই ঝামেলা নেই। হাতের কাজ সেরে বসে যান, উপভোগ করুন যোগ অনুশীলন।

যে কোনো বয়সের মানুষ যোগ অনুশীলন করতে পারেন। কিশোর থেকে প্রবীণ, নারী-পুরুষ সবাই। বিশেষ করে এটা প্রবীণ-প্রবীণাদের জন্য খুবই উপকারী। যখন বয়স ছিল, তখন শক্তি সাহস ক্ষিপ্রতা সবই ছিল। এখন সেগুলো তো নেই। তাই প্রবীণ বয়সে শক্তির বা গতির খেলা যেমন—ফুটবল, ক্রিকেট, বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন ঝুঁকিপূর্ণ। যে কোনো সময় ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত হতে পারেন। এ ছাড়া খেলোয়াড়রা যারা একসময় মাঠ দাপিয়ে গ্যালারি কাঁপিয়ে সময় কাটিয়েছেন, অবসরের পর হঠাৎ করে তাদের ওজন বেড়ে যায়। যোগ অনুশীলন তাদের সুস্বাস্থ্য রক্ষা করতে সাহায্য করবে। যোগ দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। অন্যান্য খেলাধুলা বা এক্সারসাইজে ইনজুরির চেয়ে যোগানুশীলনে ইনজুরির আশঙ্কা উল্লেখযোগ্যভাবে কম, নেই বললেই চলে। শরীরের সক্ষমতার বাইরে জোর করে করতে গেলেই শুধু এটা ঘটবে। বিভিন্ন রিসার্চ পেপারে দেখা গেছে, যোগাভ্যাস উল্লেখযোগ্যভাবে দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ কমায়। যোগাভ্যাস আপনাকে বার্ধ্যকের ছাপ থেকে রক্ষা করবে। মনের আনন্দ প্রস্ফুটিত হবে মুখমণ্ডলে। নিয়মিত যোগাভ্যাস শরীরের নমনীয়তা বাড়ায়। যোগাসনগুলো যেহেতু শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে কাজ করে, সেহেতু প্রতিটি জয়েন্টই নমনীয় থাকে। যোগ হজম শক্তি বৃদ্ধিতে ও সুনিদ্রায় সাহায্য করে। ঘুমের ট্যাবলেট খেয়েও তাড়াতাড়ি ঘুমানো যায়। কিন্তু পরদিন সকালে উঠে মনে পড়বে, ট্যাবলেট না খেলে তো ঘুমাতে পারি না। এ দুশ্চিন্তা আপনাকে আরও মুষড়ে দেবে। তাই প্রাকৃতিক নিয়মেই সমস্যা সমাধান করা ভালো। আজকাল বিভিন্ন সেনাবাহিনী, স্পোর্টস টিম ও করপোরেট অফিসে যোগচর্চার নিয়ম চালু হয়েছে। উদ্দেশ্য, মনঃসংযোগ ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। ধারণা ও ধ্যান পর্যায়ে মানুষের মনে দৃঢ়তা, সংকল্প এবং একাগ্রতা বাড়ে। ছাত্রছাত্রীদের জন্যও যোগাভ্যাস অত্যন্ত উপকারী। মনঃসংযোগ, আত্মসংযম, আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মবিশ্বাস তাকে জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে সাহায্য করবে। আমাদের দেশে যোগশিক্ষার কেন্দ্র বেশি নেই। তবে এটা নিয়ে চিন্তারও কিছু নেই। আগে ঠিক করুন, যোগ আপনাকে আকৃষ্ট করে কি না। নেটে যোগের ওপর অনেক লেখা আছে। ইউটিউবে অনেক ভিডিও আছে। সহজ-সরল আসনগুলো অভ্যাস করুন। জোর-জবরদস্তি করবেন না। হিতে-বিপরীত হবে। যোগাসন সহজ। কিন্তু প্রতিটি আসনের পারফেক্ট পজিশন আনতে সময় নেবে। আমরা যেখানে সময়ের জন্য ইন্সট্যান্ট কফি, এটিএম কার্ড, ডিজিটাল ট্রানজেকশনে অভ্যস্ত, যোগাভ্যাস তার বিপরীত। সময় নিয়ে ধীরে ধীরে করতে হবে। আজকেই যোগাসন করলাম, আজকেই ফলাফল চাই, এটা হয় না। ২১ জুন বিশ্ব যোগ দিবস। বিশ্ব যোগ দিবসের থিম হচ্ছে ‘মানবিকতা’। এটা শুধু একটা ব্যায়াম নয়। এটা জীবনযাপনের অভ্যাস। সব নিয়মের কথাগুলো ভাবুন এবং মানতে চেষ্টা করুন, দেখুন আপনার জীবন কেমন হয়। যোগ আপনাকে বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করবে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে, বিশ্বাসের আঙ্গিনা পেরিয়ে ভাবতে শেখাবে—আপনি বিশ্ব নাগরিক। পৃথিবীর যে কোনো দেশের দুঃখ-দুর্দশা আপনাকে ব্যথিত করবে, যে কোনো অঞ্চলের ফুল-ফল, অরণ্য-পর্বত-নদী আপনাকে সুখী করবে। বাতাসের যেমন সীমানা নেই, সূর্য কিরণের যেমন ভাগাভাগি নেই, তেমনি আপনার সদিচ্ছার সীমা নেই। সবার প্রতি প্রেম, সবার জন্য মমতা—এটাই যোগ। যোগের ভুবনে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আপনাকে সুস্বাগতম।

লেখক : যোগ অনুশীলনকারী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আবু সাঈদ হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু আজ

ছেলেদের জন্য কিছু স্টাইলিশ আউটফিট কম্বিনেশন

বুয়েট শিক্ষার্থীদের ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ আজ

আর্জেন্টিনার আগেই এশিয়া সফরে আসছে ব্রাজিল, জেনে নিন ম্যাচসূচি

দুর্ভিক্ষের গাজায় পদে পদে বিপদ, নিহত আরও ৬৪

বৃষ্টিতে বাইক চালাতে যেসব বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি

যুবকের কাণ্ডে ৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ

২০২৬ সালে রোজা শুরু হতে পারে যেদিন থেকে

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরাতে রিভিউ আবেদনের শুনানি ফের আজ

সকালে উঠে ভুলেও করবেন না এই ৫ কাজ

১০

উন্নত ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মূল প্রেরণা কাজী নজরুল : রিজভী

১১

কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

১২

সহপাঠীদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ, কচুরিপানার নিচে মিলল লাশ

১৩

সপ্তাহের ব্যবধানে সাড়ে ৪ হাজার সেনা হারাল ইউক্রেন

১৪

অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার পদে নিয়োগ দিচ্ছে আড়ং

১৫

রাজধানীতে আজ কোথায় কোন কর্মসূচি

১৬

এসিআই-এ নিয়োগ, আবেদন করুন অনলাইনে

১৭

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের বার্তা

১৮

বসতভিটা ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকি, সন্তানের বিরুদ্ধে বাবার মামলা

১৯

ব্রাজিলের মন্ত্রীর মার্কিন ভিসা বাতিল, দায়িত্বজ্ঞানহীন বললেন লুলা

২০
X