আর্থিক সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি আর ব্যাংক খাতের আমানতে সুদের হার কম থাকায় গত প্রায় দুই বছর ধরেই আমানতের প্রবৃদ্ধি কম। বাড়ছে না ব্যাপক মুদ্রার (ব্রডমানি) জোগান। ৮ শতাংশের ঘরে আটকে আছে ব্রডমানির প্রবৃদ্ধি। গোটা ব্যাংক খাতে রিজার্ভ মানির প্রবৃদ্ধিও ঋণাত্মক।
দেশে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আগামী জুন পর্যন্ত বাজারে ব্যাপক মুদ্রার (ব্রডমানির) সরবরাহ প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৭ শতাংশ ধরা হয়েছে। গত নভেম্বর পর্যন্ত বাজারে এই ব্যাপক মুদ্রার জোগান ছিল ১৮ লাখ ৮৯ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ৪০ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে ব্রডমানির প্রবৃদ্ধি ঘটেছে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এরই মধ্যে গত ডিসেম্বরে এই প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আবার ইসলামী ধারার কয়েকটি ব্যাংককে তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠতে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে করে বাজারে টাকার সরবরাহ আরও বেড়ে যেতে পারে। এই অবস্থায় অর্থবছরের বাকি ছয় মাসে এই ব্রডমানির সরবরাহের হার কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে, এই নিয়ে খোদ ব্যাংকিং খাতেই তৈরি হয়েছে ঘোরতর সংশয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি পদক্ষেপের সমালোচনা করে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, ‘ইসলামী ধারার যে কয়েকটি ব্যাংক দীর্ঘদিন থেকে তারল্য সংকটে ভুগছে, সেখানে কেন তারা এই অবস্থায় উপনীত হলো, সেসব সমস্যা চিহ্নিত না করে এবং সমস্যা সমাধানে বোর্ড ব্যর্থ হলে ওই বোর্ড ভেঙে না দিয়ে বরং টাকা ছাপিয়ে তাদের তারল্য সহায়তা দিচ্ছে। এমনকি এসব ব্যাংককে সহায়তা দিতে বিশেষ তহবিলও গঠন করছে। সময়ের বাস্তবতায় এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।’
এসব ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দেওয়ায় টাকার সরবরাহ ব্যাপক হারে বাড়বে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে রকম হওয়ার সম্ভাবনা অবশ্য কম। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করে তার চেয়ে বেশি অর্থ বাজার থেকে উঠিয়ে নিচ্ছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক নীতিতে থাকায় ব্রডমানি হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া কঠিন। কারণ, অর্থনীতিকে কিছুটা সংকুচিত করে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কঠোর পদক্ষেপে আছে। এই অবস্থায় ব্রডমানির জোগান ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে আমি মনে করি না’—দাবি করেন তিনি। এদিকে, ব্রডমানি জোগানের প্রবৃদ্ধি কম থাকায় গোটা ব্যাংক খাতে রিজার্ভ মানির প্রবৃদ্ধিও ঋণাত্মক। যদিও বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে ব্যাংকের অর্থ লেনদেনে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ব্যাংকগুলোয় লেনদেন বেড়েছে ১৫ শতাংশের বেশি। এ সময়ে চেক ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন কিছুটা কমলেও বেড়েছে ডিজিটাল সব মাধ্যমে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতের রিজার্ভ মানি কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৬০ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ মানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ৬ দশমিক ৪৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে দেশের ব্যাংক খাতের জনপ্রিয় মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে (আরটিজিএস ছাড়া) মোট ২৭ লাখ ৫১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে মোট লেনদেন ছিল ২৩ লাখ ৯০ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের তুলনায় এ সময়ে ৩ লাখ ৬০ হাজার ৮৮২ কোটি টাকার লেনদেন বেশি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে লেনদেনে প্রবৃদ্ধির হার ১৫ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। চেক ক্লিয়ারিং, ইএফটি, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং (এমএফএস) ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের লেনদেনের হিসাব আমলে নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় ডলারের দর বেড়েছে। এ কারণে একই পরিমাণ ডলার ক্রয়-বিক্রয়ে আগের চেয়ে বেশি অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতি বা জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের আগের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। একই পরিমাণ পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে টাকার প্রয়োজন হচ্ছে বেশি। এসব কারণে ব্যাংক খাতে আমানতের বড় প্রবৃদ্ধি না হলেও অর্থ লেনদেন বাড়ছে।
দেশের ব্যাংক খাতের মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৮৭ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। বছরের ব্যবধানে আমানতের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের একটু বেশি। একই সরকার ও বেসরকারি খাতসহ মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৫৭ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা। আগের বছরের নভেম্বরে যা ছিল ১৭ লাখ ৪৫ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এই খাতে প্রবৃদ্ধি ১২ দশমিক ১৬ শতাংশ। যদিও একই সময়ে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ।